জার্মানি থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইনে ডিপ্লোমা শেষ করে দেশে ফিরে ‘ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ’-এ মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে পড়াশোনা করেছেন মাশরেকা বিনতে মোশারফ।
জার্মানিতে লেখাপড়ার সময় তিনি লক্ষ্য করেন, জার্মানরা যখন কোন পণ্যের গায়ে ‘মেড ইন জার্মানি’ লেখাটি দেখেন, সেই পণ্যের দাম এবং মান নিয়ে ভীষণ বিশ্বাসী থাকেন তারা। ভিনদেশিদের চমৎকার এই অহংকার কড়া নাড়ে মাশরেকার মস্তিষ্কে। তখন থেকেই স্বপ্ন বুনেন যে নিজের দেশের সম্পদ নিয়ে এরকম কিছু করে দেখাবেন।
দেশে ফিরে কিছু করার জন্য যখন ছটফট, ঠিক তখনই বাবার হাতে পাটের তৈরি বাজারের ব্যাগ দেখে সোনালি আঁশকে স্বর্ণে রূপদানের ইচ্ছে জাগে উদ্যোক্তার মনে। তার চোখে পাটপণ্যই হয়ে উঠলো দেশকে বহন করার সেরা মাধ্যম হিসেবে। শুধু নিজেকে স্বাবলম্বী করার তাগিদে নয়, বরং নিজের দেশকে বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরার লক্ষেই গ্রহণ করলেন উদ্যোগ।
পাট নিয়ে নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা করলেন কিছুটা। তিনি আবিষ্কার করেন, বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী আরো কয়েকটি দেশে পাট সম্পদ উৎপন্ন হলেও বাংলাদেশের পাটের গুণগত মান অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি উন্নত। দেশীয় পণ্য, দেশীয় ঐতিহ্য এবং দেশীয় সম্পদের অহংকার বহন করে বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। তার মনে হলো, এত চমৎকার একটি দেশীয় সম্পদ থাকার পরও অন্য দেশের মুখাপেক্ষী কেনো হব? শুরু হল এক নতুন অভিযাত্রার।
সাল ২০০৪। সদ্য জন্মানো পাটপণ্য পরিকল্পনার তাগিদে একটি সেলাই মেশিন সমতূল্য অর্থ দিয়েই যাত্রা শুরু করেন উদ্যোক্তা। উদ্যোগের নাম দিলেন ক্রিয়েটিভ কালেকশন। পরিবার পরিজন যখন পাটপণ্যকে ছালার ব্যাগ বলে পরিহাস করছিলেন, ঠিক তখনই বাবাকে বটবৃক্ষের মতো পাশে পেয়েছেন উদ্যোক্তা। বাবার সমর্থন এবং নিজের সাহসের জোরেই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আত্মবিশ্বাসের সাথে চালিয়ে গেলেন কর্মযজ্ঞ।
নান্দনিক চরিত্রের অধিকারী মাশরেকা প্রথমেই কাজ শুরু করলেন পাটের ব্যাগ দিয়ে। তার ধীরে ধীরে এক দুই করে পাটের কার্পেট, ওয়াল মেট, শোপিস, ফ্লাওয়ার পট, রুম ডেকর, অফিস ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, টরটয়েজ ব্যাগ, পাটের অংশবিশেষে শাড়ি এবং পাঞ্জাবিসহ প্রায় সব ধরনের পাটপণ্য। প্রতিটি মানুষের কাছে হৃদয়স্পর্শী হলো পাট দিয়ে তৈরি অদ্বিতীয় এসব পণ্য।
যাত্রার শুরুতে একটি সেলাই মেশিন এবং একজন কর্মী ছিলেন উদ্যোক্তার সহায়ক। বর্তমানে সাভারে একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন প্রায় ৪৫ জন কর্মী। পাটপণ্য নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরেও সাড়া পাচ্ছেন মাশরেকা। মাসিক আয় প্রায় চার লাখেরও বেশি।
দেশীয় ক্রেতাদের আগ্রহের জন্যই রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় সেজান পয়েন্ট শপিং মলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ক্রিয়েটিভ কালেকশন নামে প্রথম আউটলেট খুলেছেন উদ্যোক্তা। পাশাপাশি দেশের বাইরে প্রায় প্রতিটি উদ্যোক্তা মেলায় অংশগ্রহণ করছেন।
মাশরেকা পাটপণ্যে ”মেড ইন বাংলাদেশ” ট্যাগটির চাহিদা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন বেশ কয়েকটি দেশে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও উদ্যোক্তার বাংলাদেশী পাটপণ্যের চাহিদা বেড়েই চলেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
নিজের অদম্য মনোবল এবং কর্ম পরিচিতির জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে “বহুমুখী পাটপণ্য উদ্যোক্তা অ্যাওয়ার্ড ২০১২” এবং ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে পেয়েছেন “Youngest entrepreneur award 2011”.
উদ্যোক্তা মাশরেকার মতে মনস্থির করাটাই জরুরি, তবেই মূলধন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
প্রতিটি ছেদ থেকে ইতিবাচক শিখন খুঁজতে পছন্দ করেন তিনি৷ মনে করেন প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে শেখার আছে। শিখনের প্রতি অবিরত এই আগ্রহ উদ্যোক্তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
স্বপ্নবাজ এই উদ্যোক্তা স্বপ্ন দেখেন, শুধু দেশের বাইরে নয়– বরং দেশের প্রতিটি তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ নিজ দেশের সম্পদে তৈরি দেশীয় পণ্যে গর্ব খুঁজে পাবেন। স্বপ্নযাত্রার স্বপ্ন বহুদূর। অদম্য মনোবলে এ প্রয়াসে অবিচল উদ্যোক্তা মাশরেকা বিনতে মোশারফ।
মৌমি তানজীম
উদ্যোক্তা বার্তা