বাংলা সিনেমার কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনেকগুলো দৃশ্য। যেন, কু ঝিক ঝিক করতে করতে ধুয়ো ওড়া একটা ট্রেন সাদা কালো স্ক্রিনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দিকে দৌড়াচ্ছে আর কাঁশবন দুলে উঠছে অপার আনন্দে। অনেক সাহস নিয়ে একটা দিদি তার বালক ভাইকে স্পর্ধা করতে শেখাচ্ছে। আর অবাক বিস্ময়ে ভাই অনাগত ভবিষ্যতের ডাক শুনতে পাচ্ছে। ট্রেনটা স্ক্রিন জুড়ে একটা আশা জাগিয়ে চলে যাচ্ছে। যেন এই কাশবন, এই তেপান্তরের মাঠ আর অবাক কৌতূহল মাখা চোখ জোড়া এখন অনেক কিছু দেখবে। এখনও অনেক কিছু দেখা বাকি।

বাংলা সিনেমা সেই সব অনেক কিছুই দেখিয়েছে। সোনায় বাঁধানো ছিল ষাট সত্তর দশক । তারপর উত্তম কুমার যখন মারা গেলেন বাংলা সিনেমার দর্শকরা ভেবেছিলেন এবার বোধহয় শেষের সেদিন নেমে আসবে। টলিউডকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে সামিল হলেন মিঠুন চক্রবর্তী। অমিতাভ বচ্চনও বেশ কিছু বাংলা সিনেমা করেছেন। কিন্তু মূলত রঞ্জিত মল্লিক, চিরঞ্জিত, তাপস পাল, প্রসেনজিত চ্যাটার্জিদের হাত ধরেই ভরাডুবি ঠেকানো গিয়েছে।

১৯৮০ থেকে ১৯৯০। বাংলা সিনেমা নতুন ভাষা খুঁজেছে। নতুন আঙ্গিক খুঁজেছে। নতুন ভঙ্গিমা খোঁজার চেষ্টা করে গেছে ক্রমাগত। আর সব থেকে কঠিন সময় গিয়েছে ১৯৯০ এর দশকে। কয়েকজন পরিচালক প্রযোজক, আর হাতে গোণা কয়েকজন কুশীলবের দৌলতে কোনও মতে টিকে গিয়েছিল বাংলা মেইন স্ট্রিম সিনেমা।

শত্রু, গুরু দক্ষিণা, বেদের মেয়ে জোছনা, শ্বেত পাথরের থালার মত ছবি তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মেজো, ছোটো, বড় বৌমাদের দেখার মতো আর্দ্র, আবেগ মথিত সামাজিক পালা গোছের সিনেমাগুলোই একটা সময় টলিউডের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিল।

সূর্যতোরণ কিংবা সপ্তপদী, সাত পাকে বাঁধা দেখা মার্জিত বাঙালি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেনের ছবিতে তৃপ্ত যারা তাদের জন্যে এই সময়টা আলুনি আর বিস্বাদ লাগতে শুরু করে।

সব মিলিয়ে ৯০ এর দশকের তরুণ বাঙালির জন্যে বাংলা সিনেমায় মনোরঞ্জনের উপকরণ পর্যাপ্ত ছিল না। সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন বাঙালি দর্শক। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হওয়া শুরু হয়ে যায়। কলকাতার ঐতিহ্যের সিনেমা হলগুলির হালও ছিল মুখ থুবড়ে পড়া এক একটা পরাজিত জাহাজের মত। একই ছবি শুধু কলকাতার নয়, গ্রামে গঞ্জে সর্বত্রই।

দর্শককে সিনেমা হলে টেনে আনার কাজটাই করে দেখিয়েছে কলকাতার একটি প্রোডাকশন হাউস। শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস (SVF)।

শ্রীকান্ত মোহতা। মহেন্দ্র সোনি। মূলত এই দুই ভাইয়ের কেমিস্ট্রি টলিউডকে দিশা দিয়েছে। সিনেমা থেকে বাঙালি দর্শক ঠিক কী চান সেটা নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে বুঝে গিয়েছেন ওরা। এবং বুঝে গিয়েছেন থেমে থাকলে চলবে না। প্রতি নিয়ত বদল হচ্ছে বাঙালি দর্শকের রুচি। ফলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদেরও বদলাচ্ছেন। ২০০৭ এ ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিষ্ণু মোহতা।

কম বাজেটের ছবি কিংবা বেশি বাজেটের ব্লাস্টার নয়, বরং দরকার দর্শকের পছন্দমতো এন্টারটেইনমেন্ট। সেই মনোরঞ্জনের রাসায়নিকটাই খুঁজে পেয়েছেন এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স।

নতুন ভাবনার কথা বলছিলেন তরুণ উদ্যোক্তা বিষ্ণু মোহতা। তিন ভাইয়ের মধ্যে বিষ্ণুই সব থেকে ছোটো। বলছিলেন তার প্রজেক্ট হইচই (hoichoi)-এর কথা।

হইচই তাদের স্টার্টআপ। একদম স্ক্র্যাচ থেকে শুরু করছেন। কিন্তু শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ছত্রছায়ায় পল্লবিত হচ্ছে ওদের নবীন এই উদ্যোগ। দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে যে বাঙালি দর্শক নিজের মর্জির মালিক, সেই দর্শকের বিনোদনের স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় দিতেই এত হইচই।

একে আপনি এক কথায় বাংলার নেটফ্লিক্স বলতে পারেন। তবে এই সরল সংজ্ঞাটা আদতে হইচই সম্পর্কে সঠিক কিছুই আইডিয়া দেবে না। হইচই হল এমন একটি মোবাইল অ্যাপলিকেশন, যেটা আপনি অ্যান্ড্রয়েড বা অ্যাপ স্টোর থেকে ডাউনলোড করলেই গোটা বিনোদনের খাজানা আপনার সামনে খুলে যাবে।

দেখতে পাবেন সিনেমা, অরিজিনাল ওয়েব সিরিজ, আর শুনতে পাবেন মন মাতানো সব গান। বিষ্ণু বলছিলেন ওরা শুধুমাত্র হইচইয়ের জন্যে ফিল্ম তৈরি করছে, তৈরি হচ্ছে অরিজিনাল থ্রিলার, ওয়েব সিরিজ। টার্গেট অডিয়েন্স তারুণ্যে টগবগে বাঙালির নতুন প্রজন্ম। যারা সবকিছুতেই মোবাইলে বিশ্বাস করেন।

ইন্টারনেট মিডিয়ার এই রমরমার যুগে হইচই আপনাকে দেবে কাস্টমাইজড এন্টারটেইনমেন্ট। সবটাই এই প্রজন্মের দর্শকদের কথা মাথায় রেখে বানানো। তিরিশের কোটায় বয়স বিষ্ণুর। তরুণ প্রজন্মের মন মানসিকতা আর রুচি সম্পর্কে দারুণ ওয়াকিবহাল। বলছিলেন আয়ের মডেলটাও সাধারণ মানুষ এমনকি কলেজের ছাত্রছাত্রীর পকেটের কথা ভেবেই বানানো।

আপাতত রয়েছে তিনটি মডেল। তিন মাসের, ছয় মাসের, আর বারো মাসের সাবস্ক্রিপশন প্যাকেজ। যথাক্রমে মাত্র ১৪৯ টাকা, ২৪৯ টাকা আর ৩৯৯ টাকা। ফলে বুঝতেই পারছেন দিনে দুটাকারও কমে সারা বছরের মনোরঞ্জন এখন সম্ভব। গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা পঁচিশ তিরিশ কোটি বাঙালির মন জয় করতে ওরা চাইছেন।

বিষ্ণু বিদেশে পড়াশুনো করেছেন। চাকরিও করেছেন। যেমন লয়েডস টিএসবির লন্ডন অফিসে কর্পোরেট স্ট্র্যাটেজি সামলেছেন। কেপিএমজি-তে রিস্ক অ্যাডভাইসর হিসেবে কাজ করেছেন। নিজেকে প্রোডাক্ট গাই বলে মনে করেন। স্টিভ জবসের ভক্ত।

ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের দফতরে ওর কেবিনের দেওয়ালে বিশাল একটা স্টিভ জবসের ছবি ঝুলছে। তার নিচেই ওর চেয়ার। সামনে খোলা আই প্যাড। বিষ্ণু নিজে স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেন। ক্যালকাটা অ্যাঞ্জেলস এবং ইন্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলসের সদস্য। পাশাপাশিউদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নেটওয়ার্কেও আছেন।

কলকাতা নিয়ে ভীষণই আশাবাদী। বিদেশ থেকে ফিরে এসে ২০০৭ সালে দাদাদের সঙ্গে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের হাল ধরেছেন। Co-Founder বিষ্ণু hoichoi এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব সামলান। এবং বিনোদনের এই ব্যবসাকে অন্য মাত্রায় তুলে আনতে চাইছেন এই তরুণ।

স্মৃতি চারণ করছিলেন ওদের শুরুর দিনের লড়াইয়ের কথা। পারিবারিক ব্যবসা ছিল রাখি বানানোর। বর্ধমানের কালনায় এবং সংলগ্ন গ্রামের প্রায় হাজার খানেক মহিলার হাতে বানানো রাখি বিক্রি করাই ওদের পারিবারিক ব্যবসা। কলকাতায় ওদের এখনও দোকান আছে। ওরা রাখি রফতানিও করেন। এখনও চলছে। মূলত বাবা জীবনদাস মোহতা এই ব্যবসা সামলান।

কিন্তু ১৯৯০ এর দশকে প্রথম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে ভাবনা চিন্তা যখন শুরু হয় তখন জীবনদাসই প্রেরণা দেন। রাখির ব্যবসার পাশাপাশি, মনোযোগ বাড়াতে বলেন বাংলা সিনেমা ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবসায়। ১৯৯৬ সাল। আজ থেকে প্রায় একুশ বছর আগে এই যাত্রা শুরু হয়। আর আজ শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস নিজেই একটি সাম্রাজ্য।

ডিস্ট্রিবিউশনের পাশাপাশি ফিল্ম প্রোডাকশনও ধীরে ধীরে শুরু করতে থাকেন শ্রীকান্ত মোহতারা। প্রথম সিনেমা ১৯৯৬ সালেই, স্বপন সাহার পরিচালনায় ‘ভাই আমার ভাই’। নায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।

তারপর একের পর এক সিনেমা করে গিয়েছেন ওঁরা। আয়, ব্যয়, লাভ, লোকসান এসবে খুব বেশি বিচলিত না হয়েই বাংলা সিনেমায় দাঁত ফোটানো শুরু করে দেয় শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মস। সখী তুমি কার, মায়ের বন্ধন, রণক্ষেত্র, নাগ নাগিনী এসব সিনেমা দিয়েই শুরু হয় বাংলা সিনেমায় নিজেদের হাত পাকানোর কাজ।

কিন্তু ২০০০ সালে হরনাথ চক্রবর্তীর শ্বশুর বাড়ি জিন্দাবাদ প্রথম এনে দেয় সাফল্যের সেই অনির্বচনীয় স্বাদ। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক নতুন নায়ক নায়িকাদের নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।

ওদের সৌজন্যেই জিত, দেব, প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদী, অর্পিতা পাল, শ্রাবন্তী থেকে শুরু করে এই মুহূর্তে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্টারডমের সব বাসিন্দাই দর্শকদের নজর কেড়েছেন।

বাংলা সিনেমার প্রায় সব পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন শ্রীকান্ত মোহতারা। স্বপন সাহা, হরনাথ চক্রবর্তী তো বটেই পাশাপাশি রিঙ্গো ব্যানার্জি, রবি কিনাগি, প্রভাত রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন, কৌশিক গাঙ্গুলি, রাজ চক্রবর্তী, সৃজিত মুখার্জি, কমলেশ্বর মুখার্জি, বিরশা দাশগুপ্ত, অরিন্দম শীল। কে নেই সেই তালিকায়।

এই একুশ বছরে একশ দশটিরও বেশি ছবি প্রডিউস করে ফেলেছেন শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মস । চোখের বালি, রেনকোট, মেমোরিস ইন মার্চ, ছোটোদের ছবি, অপুর পাঁচালি আর চাঁদের পাহাড়ের জন্যে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মস।

পাশাপাশি, টিয়ার টু, টিয়ার থ্রি শহরগুলিতে তৈরি করেছে উন্নত মানের নতুন নতুন সিনেমা হল। বাংলা সিনেমার হারিয়ে যাওয়া দর্শকদের আবারও ওরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন সিনেমা হলে। এখন তামাম শহর কলকাতা আইনক্সে মোটা টাকার টিকিট কেটে বাংলা সিনেমা দেখতে ছোটে।

এই পরিস্থিতি নির্মাণ করতে পেরেছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। কমার্শিয়াল সিনেমার এই তিন পূজারী বিশ্ব সিনেমার শৈল্পিক ধারার প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল। সেটা বোঝা গেল, যখন বিষ্ণু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখাচ্ছিলেন ওদের অফিস। এক একটি ঘর, বিশ্ব সিনেমার এক একজন দিক পালের নামে উৎসর্গীকৃত।

সেখানে স্পিলবার্গের নামে যেমন ঘর আছে, তেমনি আছে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, এবং ঋতুপর্ণা ঘোষের নামেও প্রশস্ত ঘর। ঋতুপর্ণের ঘরে ঢুকেই মনে হবে লোকটা যেন এখানে বাস করেন। দেওয়ালে ঝুলছে ওর ব্যবহার করা জ্যাকেট। বইয়ের তাকে সাজানো বই। পরিপাটি সাজানো বৈঠক খানা।

শ্রদ্ধা বেড়ে গেল শ্রী ভেঙ্কটেশের প্রতি এই অসামান্য সবিনয় ট্রিবিউটে।

(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here