জামালপুরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। ছেলেবেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খাতায় নাম ছিল আরিফ। হঠাৎ করেই এক ঈদে জামা কেনার সময় শার্টের বদলে কিনে ফেললেন মেয়েদের জামা।
অস্বাভাবিক দৈহিক গঠন ও আচরণ এর দেখা মিলতে থাকলো একটু একটু করে। প্রাকৃতিক নিয়মের নানান অসঙ্গতি প্রকাশ ধীরে ধীরে হলেও নিগৃহীত হতে খুব বেশি সময় দেয়নি সমাজ ও পরিবার। শৈশবের দিনগুলো অন্য শিশুদের মত আনন্দে কাটলেও আনন্দ হারিয়ে গেল বাড়ন্ত বয়সে।
একটা সময় আরিফ হয়ে উঠলেন আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী। ইতোমধ্যে আশপাশের সবার কাছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হলেন। একসময় বাবা পরপারে চলে গেলেন। সময়গুলো দিনকে দিন হতে থাকলো কঠিম থেকে কঠিনতর।
নানান প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে ২০০১ সালে এসএসসি এবং ২০১০ সালে স্থানীয় পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। বহু কষ্টে লেখাপড়া শিখেও ময়ূরী চাকুরী পাননি। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাময়িক চাকরি হলেও সেখানেও বৈষম্য কম ছিলনা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ‘সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার’ পদের ভাইভা বোর্ডে “আপনি মেয়েদের মতো পোশাক পরে কিভাবে কাজ করবেন?” জাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয়েছে।
সামাজিক বাঁধায় যখন মুষড়ে পড়ার উপক্রম তখনই ২০১৩ সালে ৬০/৭০ জন কর্মী সদস্য নিয়ে গড়ে তোলেন সিঁড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থা। বিভিন্ন রকম হস্ত শিল্প যেমন- হাতের তৈরী শোপিস, ব্যাগ, ওয়ালম্যাট হাতের কাজের তৈরী পোশাক ও বিভিন্ন হোম ডেকর পণ্য নিজে বানাতেন এবং কর্মীদের শেখাতেন তৃতীয় লিঙ্গের সাধারণ এক জোড়া হাত সেখানে গড়ে তুললো শতশত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্মসংস্থান।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের এভাবে মূলধারায় নিয়ে আসতে ও স্বাবলম্বী করে তুলতে পারার এই সাহসিকতায় ২০১৬ সালে অর্জন করেন জয়িতা পুরস্কার। এ পুরস্কার পাওয়ার পর নিজের কাজের গতি অনেকগুণ বেড়েছে বলে জানান তিনি।
‘সিঁড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ সংগঠনটি সমাজে কী ভূমিকা রাখছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফা ইয়াসমিন উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন: জামালপুর জেলায় সমাজ উন্নয়ন কাজ করছে এই সংগঠন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শেষে আমরা হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হই। ৬০-৭০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ জামালপুরে হস্তশিল্পের কাজ শুরু করি,আমাদের মতো অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছে, আমরা স্বাবলম্বী হচ্ছি।
তিনি বলেন, আমার এলাকায় বন্যায় কবলিত মানুষকে ত্রাণ বিতরণ করি, ঈদুল আযহায় গরীবের মাঝে কোরবানীর মাংস বিতরণকরি। শীর্তাত মানুষের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করি।
এসব করতে কোন প্রতিবন্ধকতা আসে কিনা জানতে চাইলে আরিফা বলেন: এগুলো করতে গেলেও আমাদের অনেক হোঁচট খেতে হয়। নানা ধরনের বাজে কথা শুনতে হয়।
সুবিধা বঞ্চিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলাসহ তাদের স্থায়ী বাসস্থান, শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট তৈরীর লক্ষ্যে অ্যাডভোকেসি করছেন।
তৃতীয় লিঙ্গের কর্মীদের বিপুল সম্ভাবনায় সিড়ি হস্তশিল্পের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করছেন দেশ-বিদেশের নানান সেমিনার ও কর্মশালায়।
চলতি বছরে ৭ম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলায় বিশেষ ক্যাটাগরিতে জিতেছেন সেরা উদ্যোক্তার জাতীয় সম্মাননা। ইচ্ছাশক্তি ও শ্রমের কাছে সব প্রতিকূলতা হার মানতে বাধ্য তা প্রমান করেছেন সফল উদ্যোক্তা আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী।
সাদিয়া সূচনা