সাইকেলে স্বপ্নজয়

0

২০১৪ সাল। নর্থ-সাউথ এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির দুজন ছাত্র তামজীদ এবং তাবরীজ। তারা দুজনে পড়াশোনা করেন এবং ভাবলেন পাশাপাশি কিছু একটা নিজেরা শুরু করবেন। তারা বিশ্বের সব বিখ্যাত উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের অনেক ডকুমেন্টরী দেখেছেন। তাদের ওপর নির্মিত সব ডকুমেন্টরী দেখে দুই ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রের চোখে স্বপ্ন জাগে, জীবনে কিছু করবার। হোক ভীষণ ছোট, কিন্তু ছোট থেকেই তো সব হয় শুরু। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ১৭ হাজার টাকায় মাত্র দুটি সাইকেল নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন দুই তরুণ এবং স্থাপন করলেন একটি স্বপ্ন।

চিত্রঃ র‍্যাপিডো ডেলিভারীর কর্মীরা পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে

ই-কমার্স সেক্টর কেবল সাড়া মেলছে। সে সময়টাতে শুরু হলো পড়াশোনা। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া বন্ধু তাবরীজ তামজীদ কে বললেন, দুজনার যে সাইকেল আছে, সেই সাইকেল চড়েই দুটো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে শুরু করে দেয়া যাক। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করা দুই বন্ধুর বিষয় বা ব্যবসার উদ্যোগ কি হবে? ই-পার্সেল অর্থাৎ, ই-কমার্স সাইটে যারা পণ্য বিক্রয় করেন অথবা কিনবেন, তাদের মাঝখানে পণ্য নেয়া এবং পৌঁছে দেয়ার জন্য ছোট্ট একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেন দুই বন্ধু। নাম দেয়া হলো- ‘র‍্যাপিডো ডেলিভারী’। যাত্রা শুরু হলো সাইকেলে চড়ে। প্রথম এক মাস বিশাল ঢাকা কে দুই ভাগ করলেন দুই তরুণ, তাদের স্বপ্ন দিয়ে ভাগ করে নিলেন। ১ জন নিলেন যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরা।আরেক জন ধানমন্ডি, মোহাম্মাদপুর, মিরপুর এবং গুলশান। ফেসবুক পেজ খোলা, এবং সেই পেজের হটলাইন নাম্বারের স্ক্রীনের দিকে চেয়ে থাকা, অপেক্ষা করা। ৪৮ ঘন্টা পর প্রথম কল তথা প্রথম কাস্টমার এর সাড়া মিললো। “বাইং বিডি” থেকে একজন পণ্য কিনেছেন, সেটা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পেলেন দুই তরুন।

উদ্যোক্তার সফলতার গল্প দেখুন ইউটিউবে-দেখতে ক্লিক করুন

চিত্রঃ র‍্যাপিডো ডেলিভারীর পণ্য ডেলিভারী দেয়ার উদ্দেশ্যে কর্মীদের যাত্রা

মতিঝিল থেকে পণ্যটা তুলে গুলশান-১ এ পৌঁছে দিতে হবে। বিকেল ৫টার মধ্যে পৌঁছে দিতে না পারলে অর্ডার টা বাতিল হয়ে যাবে। যারা জীবনে চ্যালেঞ্জ লুফে নেন তারাই জিতেন। চ্যালেঞ্জ টা লুফে নিলেন দুই বন্ধু। তামজীদ ছুটলেন। বিকাল ৪:২৫ এ পণ্য  ডেলিভারী করলেন কাস্টমারের হাতে পণ্য। জানতে ইচ্ছে করছে নিশ্চয়, কত টাকা সাইকেল চালিয়ে প্রথম লাভ করেছিলেন দুই তরুণ? মাত্র-৬০ টাকা। ১টি ৫০ টাকার নোট এবং ১টি ১০ টাকার নোট। লভ্যাংশ কত বড় মানবিক শক্তি হতে পারে, হতে পারে অদম্য মনোবল আনবার প্রেরণা।সাইকেল দুটোর গতি এবং শক্তি বেড়ে গেল অনেক। এরপর অর্ডার আসা শুরু করলো। ২য় মাসেই দুই সাইকেল এর জায়গায় হলো ৪টি সাইকেল। অফিস এখন রাস্তাই শুধু চলা নয়, অফিসে বসাও। লক্ষ্য ছিল ৩০ দিনে ৩০টি পার্সেল পৌঁছে দেয়া, কিন্তু সে জায়গায়-১৭৩টি পার্সেল ডেলিভারী করে নিজেদের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করলেন দুই উদ্যোক্তা- তাবরীজ এবং তামজীদ। ২০১৫ সাল, ক্লায়েন্ট ফ্যাসিনোঃ- অনলাইন ষ্টোর। পার্সেল এর বহর বাড়িয়ে দিল বহুগুণ। প্রতিদিন গড়ে ৫টি করে পার্সেল পৌঁছাতে হয় র‍্যাপিডো ডেলিভারীসকে। এক এক করে ক্লায়েন্ট বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে প্রায় ২০০ জন রেজিস্টার্ড ক্লায়েন্ট লিস্ট এ পার্সেল পৌঁছাতে থাকলো দুই তরুণ উদ্যোক্তা তামজীদ এবং তাবরীজের র‍্যাপিডো ডেলিভারীস। বাধা এসেছে, মানবিক বাধা।নগদ টাকা পৌঁছে দেবার যে অঙ্গীকার, সে ‘অঙ্গীকার’ যখন রাস্তায় সাইকেল, মোবাইল, ব্যাগ এবং নগদ টাকা কেড়ে নেয়া বা ছিনতাই হয় কিনা, মানসিক ভাবে ভীষন ভেঙ্গে পড়েন দুজন। কিন্তু ই-কমার্স সেকশন-এ কমিটমেন্ট ইজ কমিটমেন্ট। গ্রাহক এবং অনলাইন অর্ডার মধ্যকার যে অঙ্গীকার তাবহন করলেন দুই উদ্যোক্তা। নিজেদের টাকা থেকে, ক্যাশ অন ডেলিভারীটি যথা সময়ে সম্পন্ন করলেন। ব্যবসায় সফলতা আসতেই থাকে। যেখানে প্রত্যয় থাকে সীমাহীন ইস্পাতসম দৃঢ়তার।

চিত্রঃ র‍্যাপিডো ডেলিভারীর কর্মী সময়মতো পণ্য ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিলেন

২০১৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ‘কানেক্টিং স্টার্টআপ প্রতিযোগীতায়’- ৪০০ জনের মাঝে সেরা-২৫ এ স্থান করে নিলেন দুই তরুণ, র‍্যাপিডো ডেলিভারীস নিয়ে প্রমান করলেন তাদের প্রোজেক্ট, প্রেজেন্টেশন দিয়ে মোটামুটি ভাবে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের আইসিটি সেক্টরে। ২০১৬ সালে-৩১৭ জন এর মতো ক্লায়েন্ট বেড়ে দারিয়েছে। আজ অনলাইনে কাপড়, টি-শার্ট, মধু, গাওয়া ঘি, আঁচার, কসমেটিক্স, বই, মোবাইল ফোন, এবং গ্যাজেডস এরকম নানা রকম পণ্য মিলিয়ে প্রায় ৫০ ধরনের পণ্যের একটি প্রোডাক্ট লাইনে পার্সেল ডেলিভারী করছে র‍্যাপিডো ডেলিভারীস।

চিত্রঃ র‍্যাপিডো ডেলিভারীর কর্মীরা অর্ডার সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত

নিয়মিত সাইকেল ৬টি এবং ডেলিভারী ম্যান সাইকেল ৩টি, মোট ৯টি সাইকেল। ৮ জন নিয়মিত কর্মী মিলিয়ে ৩১৭ জনের উপর ক্লায়েন্ট লিস্ট। ১৭ হাজার টাকার মাত্র দুটি সাইকেল নিয়ে অনলাইন ই-কর্মাস সেক্টরে কাজ শুরু করা র‍্যাপিডো ডেলিভারীস এর দুই তরুণ উদ্যোক্তা তাবরীজ এবং তামজীদ আজ সফলতার সাথে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে চলেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here