বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে মানুষকে কতোটা আচ্ছাদিত করে ফেলেছে তা আমরা এই মহামারির সময়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি না ঘটলে এখন হয়তো আমাদের জীবন-জীবিকা প্রায় স্থবির হয়ে পড়তো। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারাও এই সময়টাকে সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। ২০০২ সালে কাজ শুরু করলেও সরকার প্রায় সাত বছর পরে, ২০০৯ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। এ-প্রেক্ষাপটেই ২০২১ সাল নাগাদ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ২০১০ সালে গঠিত হয় হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।
শুধু শহরই নয় বরং জেলা-উপজেলা সদর ছাড়িয়ে গ্রাম এমনকি প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলেও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দিয়েছে সরকার। ২০১৮ সালে দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের আয় ছিলো ১০০ কোটি ডলার। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ এ-আয় ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ-জন্য দেশব্যাপী ২৮টি হাইটেক পার্ক নির্মাণ করেছে সরকার।
নতুন দশকের শুরুতেই ফাইভ-জি প্রযুক্তি মানুষের কাছে চলে এসেছে। এ-প্রযুক্তির হাত ধরেই এসেছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, রোবোটিকস ও বিগ ডেটা এর মতো নানা কাজ। অর্থাৎ, প্রয়োজন হচ্ছে দক্ষ কর্মীর। আগামী এক দশকের মধ্যে আরও নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এসে নতুন চাকরি সৃষ্টি করবে।
এ-ছাড়া বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে আউটসোর্সিংয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বে বছরে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে আউটসোর্সিংয়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এ-খাতে আয় করছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। এ-খাতে বছরে আয় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর-সঙ্গে ফ্রিল্যান্স-আউটসোর্সিং পেশাজীবীরা আরও প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে। ফলে বিশ্বের ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয় ২০২১ সালে আউটসোর্সিং থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। তাতে জিডিপিতে এ-খাতের অবদান দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। বর্তমানে এ-খাতে সাড়ে ১০ লাখ মানুষ যুক্ত থাকলেও, ভবিষ্যতে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের বিশাল সম্ভাবনা দেখছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা।
আউটসোর্সিংয়ের জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ ও ব্রডব্যান্ড। এ দুটোই নিশ্চিত হয়েছে দেশে। ১০ বছর আগেও ইন্টারনেট খরচ ছিল ১ হাজার মার্কিন ডলার। আর এখন সেটা হাতের নাগালে। এজন্যই দেশের তরুণরা ঘরে বসে আয় করতে পারছে। যেটা ১০ বছর আগে চিন্তাই করা যেত না। বিশ্বের সবচেয়ে ক্রমবর্ধমান ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে এই বিপিও খাত। কিছু দিনের মধ্যে ৬০ শতাংশ চাকরি আউটসোর্সিং খাত থেকে আসবে। আইসিটিতে বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিবর্তনের গল্প, তার উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে বিপিও খাতের। সরকার আইসিটি সেক্টর থেকে ২০২১ সাল নাগাদ যে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, আশা করা হচ্ছে তার সিংহভাগ অংশই আসবে এই বিপিও থেকে। আউটসোর্সিংয়ের এ-বাজার ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। এ-বাজার বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। এ-জন্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে। এই বিপিও খাত শুধু নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিই নয়, দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও বড় অবদান রাখতে পারে। বিপিও খাতে আমাদের আয়ের প্রবৃদ্ধি বছরে শতকরা ১০০ ভাগেরও বেশি। এটি আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
আইসিটিতে আয় করার জন্য উচ্চ শিক্ষিত হতে হয় না। কিছু প্রশিক্ষণ নিয়েই কাজ করা যায়। দেশের ৭০ শতাংশ তরুণের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। এদের কাজে লাগাতে পারলেই আউটসোর্সিংয়ের সম্ভাবনা সত্যি হয়ে দেখা দেবে। বর্তমানে লার্নিং আর্নিং কর্মসূচীর মাধ্যমে এসএসসি, এইচএসসি পাস ছেলে-মেয়েরাও তাদের গ্রামের বাড়িতে বসেই ডলার আয় করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ৩৭ শতাংশ আসে মেধাস্বত্বকে কাজে লাগিয়ে।
আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশকে যে কল সেন্টার এবং ডাটা এন্ট্রি কাজের মধ্য দিয়ে বিপিওর ধারাটির সূচনা ঘটেছিল, সময়ের পরিক্রমায় এখন এটি বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটির পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে এ ব্যাপারে নতুন একটি জাগরণ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে ‘বিপিও’ একটি নতুন সম্ভাবনার নাম। কারণ বাংলাদেশের বিপিও ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বছরে শতকরা ১০০ ভাগের বেশি। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিপিওর বাজার ৫০০ বিলিয়ন ডলার। সেখানে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ দখল করতে পেরেছে মাত্র ১৮০ মিলিয়ন ডলার | ফলে সহজেই অনুমেয়, বিপিও খাতে একটা বিশাল বাজার পড়ে আছে। এখন যদি বাংলাদেশ এখাতে নজর দেয় তাহলে তৈরি পোশাকশিল্পের পরই আইসিটি খাত হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত। এছাড়া নতুন উদ্যোক্তাদের সৃজনশীল মেধাকে কাজে লাগিয়ে এ-খাতেই নিজেদের কর্মজীবনের ভবিষ্যত গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা