তাহমিনা আজম, জন্ম মানিকগঞ্জে, বেড়ে ওঠা ঢাকার ধানমণ্ডিতে। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাষ্টার্স করে একটা নামকরা স্কুলে চাকরি করতেন। বিয়ের পর একমাত্র ছেলের জন্য চাকরিটা ছেড়ে দেন। কিন্ত তিনি সব সময়ই চাইতেন নিজে কিছু একটা করবেন, নিজের একটা পরিচয় দাঁড় করাবেন। সেই ভাবনা থেকেই তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা।
তাহমিনা আজমের উদ্যোগের নাম টোপাজ ফ্যাশন। ধানমণ্ডি এডিসি এম্পায়ার প্লাজাতে তার নিজস্ব একটা শো রুম আছে। উদ্যোগের শুরুটা নিয়ে তাহমিনা জানান: আমি যখন আমার ছেলেকে নিয়ে তার স্কুলে যেতাম, তখন দেখতাম অন্য বাচ্চাদের অভিভাবকরাও স্কুলের সামনে বসে গল্প করতো, আড্ডা দিতো। আমিও মাঝেমধ্যে বসে থাকতাম, কিন্তু বিষয়টা আমার ভালো লাগতো না। মনে মনে ভাবতাম অবসর সময়টাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়! সেই ভাবনা থেকেই বাড়িতে বসে পটারি নিয়ে কাজ করতাম।
ছোটবেলা থেকেই তিনি পটারি করতে ভালোবাসতেন। পটারির উপর বিভিন্ন ডিজাইন করতেন। সেগুলো আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের গিফট করতেন, অনেকে পছন্দ করে কিনতেন, আবার অনেক সময় তার শাশুড়িও তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে অন্যকে গিফট করতেন।
তিনি বলেন, “আমার উদ্যোগের প্রথম ক্রেতাই হচ্ছেন আমার শাশুড়ি। মূলত উনার উৎসাহেই আমার উদ্যোক্তা হবার চিন্তাটা আসে।”
তাহমিনা জানান, তিনি যখন উদ্যোগ শুরু করেন ওই সময় ব্লক বাটিকের খুব প্রচলন ছিল। তিনি পটারির সাথে সাথে ব্লকের বিভিন্ন রকমের জামা, ড্রেসও বানাতেন। তার কিছু বান্ধবী ছিল, তারাও বিভিন্ন রকমের প্রডাক্ট তৈরি করতেন। এরপর তারা পাঁচ বান্ধবী আলাপ করে ঠিক করলেন, পাঁচজনে মিলে একত্রে কিছু একটা করবেন। সবাই মিলে ৫ হাজার টাকা করে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে, প্রথমে বুটিকের উদ্যোগ শুরু করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন একটা শো রুম নেবেন।
তাহমিনা আজম বলেন: আমাদের সাথে এক আন্টি ছিলেন, তিনি আমাদের পরিকল্পনা শুনে বললেন, তোমরা আমার বাড়ির একটা ফ্লোরকে শোরুম হিসেবে ব্যবহার করতে পারো, আমার ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে থাকে, এতে তোমাদেরও লাভ হবে, আমারও ভালো সময় কাটবে। আমরা ওই আন্টির কথমতো উনার বাড়ির নিচ তলাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে আমাদের উদ্যোগ শুরু করি।
‘এভাবেই পাঁচ বছর পর্যন্ত আমাদের ওই ব্যবসা চলছিল। কিন্ত এক সময় পাঁচজনের মধ্যে দু’জন বিদেশ চলে যায়, অন্য দু’জন সংসারের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের আর একসাথে কাজ করা হয়ে উঠে না। এর মধ্যে একটা বড় কোম্পানি আমাকে একটা সুযোগ দিলো, তারা অফার দিলো আমি তাদের শোরুমের এক পাশে বুটিকের প্রডাক্ট সেল করতে পারবো, বিনিময়ে তাদেরকে একটা পার্সেন্টেজ দিতে হবে। আমি ওই বড় কোম্পানির সাথেও চার-পাঁচ বছর কাজ করেছিলাম। তারপর ভাবলাম অন্যের অধীনে না থেকে স্বাধীনভাবে নিজের জন্য কাজ করা দরকার। সেই ভাবনা থেকে ঠিক ছয় বছর আগে ছোট একটা শোরুম নিয়ে আমার টোপাজ উদ্যোগ শুরু করি,’ বলে জানালেন তিনি।
তাহমিনা আজমের নিজস্ব একটি কারখানা রয়েছে যেখানে দু’জন কর্মী রয়েছেন। চাহিদা অনুযায়ী পার্টটাইমার হিসেবেও তিনি লোক নিয়ে থাকেন। তিনি নিজস্ব ডিজাইনেই পণ্য তৈরি করে থাকেন। বিশেষ করে তার কারখানায় এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন প্রিন্টের ও হাতের কাজের পণ্য তৈরি করা হয়। এছাড়া তার ধানমণ্ডির শোরুমে তিনজন দক্ষ কর্মী রয়েছেন। তাদের সহযোগিতায়ই তিনি নিশ্চিত ভাবে কাজ করে যেতে পারছেন বলে জানান।
তাহমিনার “টোপাজ” প্রতিষ্ঠানে শাড়ি, কামিজ, সিঙ্গেল টপ, কুর্তিসহ নানা ধরনের পণ্য রয়েছে। অফলাইন ও অনলাইন দু’ভাবেই তিনি পণ্য সেল করে থাকেন। প্রতি মাসে তিনি ২ লক্ষ টাকার পন্য উৎপাদন করেন, তবে বিভিন্ন উপলক্ষে উৎপাদন বেশীও হয়। বতর্মানে তার প্রতি মাসে সেল হয় ১ লক্ষ টাকার মতো।
তিনি বলেন: বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমি আমার পণ্য সেল করে থাকি। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতেও আমার অনেক পণ্য যায়, বিভিন্ন উপলক্ষগুলোতে আমরা এক সাথে একই ডিজাইনের পণ্য তৈরি করে বিদেশে পাঠিয়ে থাকি। তারা খুশি হয়ে আমাদেরকে তাদের অভিব্যক্তি জানায়।
তাহমিনা আজম বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তাদের অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাই বেশি আসে। আমার বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আমি উচ্চশিক্ষিত হয়ে, চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হই, সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো, কেউ কেউ ঠাট্টা করে আমাকে বলেই ফেলতো তুমি তো দেখি সওদাগর হয়ে গেছো! তাতে অবশ্য আমি দমে যাইনি। আমি আমার উদ্যোগ নিয়ে ঠিকই এগিয়ে গিয়েছি।
তবে পারিবারিকভাবে তিনি কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হননি। স্বামী, শাশুড়ি এবং পরিবারের সবার সর্মথনেই উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন।
তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে উদ্যোক্তা তাহমিনা আজম বলেন: স্বপ্নটা থাকতে হবে বিশাল আর ধৈর্য্যটা থাকতে হবে তার চেয়েও বেশি। আর যে কাজই আমরা করি না কেন, সেটা খুব মমতার সাথে করতে হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে উদ্যোক্তা তাহমিনা বলেন, ‘আমার টোপাজকে সারা বিশ্ব চিনবে এই প্রত্যাশা নিয়ে আরো ভালো ভাবে কাজ করে যেতে চাই।’
আফসানা অভি
উদ্যোক্তা বার্তা