সুধা মূর্তি ১৯২১ সালের ১৯শে আগস্ট কর্ণাটকের শিগগাঁওতে একটি মাধওয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।পিতা ছিলেন একজন সার্জন ডা: আর এইচ কুলকার্নি এবং তার মা বিমলা কুলকার্নি। তিনি এবং তার ভাইবোনেরা তার বাবা-মা এবং দাদু-দিদিমার কাছেই বড় হয়েছিলেন।।
এই শৈশব অভিজ্ঞতাগুলি তার প্রথম সাহিত্য “হাউ আই টট মাই গ্রান্ডমাদার টু রীড আন্ড আদার স্টোরিস”-এ উঠে এসেছে। মূর্তি বি ভি বি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বর্তমানে কেএল ই টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত) থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং-এ ক্লাসে প্রথম হয়ে, বি ই সম্পন্ন করেন এবং কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থা থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করেন এবং ইনস্টিটিউট অফ এঞ্জিনিয়ার্স থেকে স্বর্ণ পদক লাভ করেন.
সুধা এমন একটি সময়ে অ্যানিইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার হতে বেছে নিয়েছিলেন যখন এটি একটি ‘পুরুষ-প্রধান পেশা হিসেবে বিবেচিত ছিল। TELCO (বর্তমানে টাটা মোটরস) তাকে প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেয়। পুণেতে একজন ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কোম্পানির সাথে যোগ দেন এবং তারপর মুম্বাই ও জামশেদপুরেও কাজ করেন। খুব দ্রুতই তিনি লিঙ্গ-পক্ষপাতমূলক পেশার বিরুদ্ধে একটি প্রতীক হয়ে ওঠেন এবং অন্যান্য অনেক কোম্পানিকে তাদের কর্মশক্তির বৈচিত্র্য নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেন। পরবর্তীতে তিনি ওয়ালচাঁদ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সিস্টেম বিশ্লেষক হিসাবে যোগ দেন।
পুণেতে টেলকো তে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সুধা মূর্তি বিয়ে করেন এন আর নারায়ণ মূর্তিকে।
১৯৮১ সালে সুধা মূর্তিকে তাঁর স্বামী বলেছিলেন যে তিনি একটি সফ্টওয়্যার কোম্পানি শুরু করতে চান। তখন তাঁরা দুজনেই ভাল বেতনের চাকরি করতেন। প্রথমে সফ্টট্রোনিক্স নামে একটি আইটি কোম্পানি খুলে ব্যর্থ হয়েছিল নারায়ণ । তারপর একদিন বলল, আবার ব্যবসা শুরু করতে চাই। ১০ হাজার টাকা চাইল। সুধার কাছে জমানো ১০২৫০ টাকা ছিল। ভয়ে ভয়ে কোম্পানি শুরু করার জন্য ২৫০ টাকা বাঁচিয়ে ১০ হাজার টাকা দিলেন স্বামী নারায়ণ মুর্তির হাতে । কারণ আমার মনে আশঙ্কা ছিল যদি এবারেও ফেল করে। তাই আড়াইশো টাকা রেখে দেওয়া। পরবর্তীতে সকল ভয় আপত্তি দূরে সরিয়ে রেখে সুধা-ই হয়ে ওঠেন নারায়ণের উদ্যোগ ‘ইনফোসিস’-এর অন্যতম কাণ্ডারি। একদিকে, সুধা তখন ছোট্ট দুই সন্তানের মা। অন্যদিকে তিনি-ই ইনফোসিসের প্রোগ্রামার-স্বামীর সেক্রেটারি-অফিসের রাঁধুনি ও কেরানি। শুরু হয় ইনফোসিস। এরপর বদলে যায় গোটা পরিবারের জীবনযাত্রা।
সমাজকর্মী সুধা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ইনফোসিস ফাউন্ডেশন’-এর পুরোধা। ১৯৯৬ সালে তৈরি এই সংস্থার সমাজসেবার বিস্তৃত শাখায় ব্রতী। মুর্তির সংস্থা ইনফোসিস এর নানারকম সমাজসেবামূলক কাজের মধ্যে রয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, জনস্বাস্থ্য, শিল্প ও সংস্কৃতি, এবং তৃণমূল পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচন। ‘প্রতিটি স্কুলের জন্য একটি গ্রন্থাগার’ তার এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে এখন পর্যন্ত ৭০,০০০টি লাইব্রেরি স্থাপন করেছে তার সংস্থা। তিনি ব্যাঙ্গালোর শহরে কয়েকশ টয়লেট এবং গ্রামীণ এলাকায় ১৬,০০০ টি টয়লেট নির্মাণ করে গ্রামীণ এলাকায় সাহায্য করছেন। ইনফোসিস ফাউন্ডেশন একটি পাবলিক চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং সুধা মুর্তি ট্রাস্টিদের মধ্যে একজন। ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ২৩০০টি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তিনি তামিলনাড়ুতে এবং আন্দামানে সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ , গুজরাট কচ্ছ অঞ্চলে ভূমিকম্প , ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের বন্যা ও হারিকেন এবং কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রে খরা তেও সেবাকার্য চালিয়েছেন। সাহিত্যপ্রেমী সুধা নিজে বই লেখেন। ইতিমধ্যেই কন্নড় ও ইংরেজিতে বাচ্চাদের জন্য বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন তিনি। ২০১১-১২ অর্থ বছরে তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য কর্ণাটক সরকার তাঁকে সম্মানিত সাহিত্য পুরস্কার, ‘আতিমাববে পুরস্কার’ প্রদান করেছিল।
গত বছর সামাজিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সুধা মূর্তিকে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘পদ্মভূষণ’-এ ভূষিত করেছিল ভারত সরকার। এবং সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য (এমপি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সুধা মূর্তি।
সুধা মূর্তি বলেন যে একটি সংস্থা তৈরি করা কোনও মজার ব্যাপার নয়, সহজ ব্যাপারও নয়। এর জন্য অনেক ত্যাগের প্রয়োজন। প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে একজন মহিলা আছেন যিনি তাকে দুর্দান্ত কিছু শুরু করতে ঠেলে দিয়েছিলেন। সুধা মূর্তি তার স্বামী নারায়ণ মূর্তিকে ধার দিয়ে ইনফোসিসকে ধারণ করতে সাহায্য করেন, ২০২৩ সালের এপ্রিলের হিসাবে নারায়ণ মূর্তির সম্পদের পরিমাণ ৪১০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু সবকিছুর পরেও মূর্তি দম্পতি বিশ্বাস সাধারণ জীবনযাপনে। বাকি শিল্পপতিদের মতো মহার্ঘ্য সাজপোশাক তো দূর অস্ত, গত প্রায় দু’দশকের বেশি সময় হল, সুধা মূর্তি কোনও শাড়িই কেনেননি। যশ ও খ্যাতি শীর্ষে পৌঁছেও মেধাবী সুধার জীবনদর্শন বাঁধা আটপৌরে সুরেই।
একজন উজ্জ্বল ছাত্রী হওয়া থেকে শুরু করে সহায়ক স্ত্রী হওয়া পর্যন্ত, সুধা মূর্তি প্রমাণ করেছেন যে নারীরা এই টেস্টোস্টেরন-ভরা পৃথিবীতে পুরুষদের চেয়ে কম সক্ষম নয়।