রাজশাহী কলেজের ইংরেজী সাহিত্য বিষয়ের ছাত্রী জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট। জুলিয়েট নামটি শুনলেই ইংরেজী সাহিত্যের কোন এক গল্পের কোন এক চরিত্রের কথা মনে পরে যায়। প্রথম বর্ষে পড়া অবস্থাতে মাত্র ১২০০ টাকা দিয়ে নিজের করা ডিজাইনে ড্রেস তৈরি করেন জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট। এরপর বান্ধবীদের পছন্দের ডিজাইনের ড্রেস তৈরি করে দিতে দিতে নিজে একজন ডিজাইনার হয়ে উঠেন এবং জুলিয়েট যিল নামে নিজের উদ্যোগকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এগিয়ে যান সফলতার দিকে।

১৯৯৯ সাল, অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া একজন কিশোরী কোনো ভাবেই মার্কেটে যে পোশাকগুলো পাওয়া যেত তা পরতে চাইতেন না। মা শত চেষ্টা করেও কমন কোনো ডিজাইন মেয়েকে কিনে দিতে পারেননি। যদি দু একটা অনন্যসুলভ ডিজাইনের পোশাক মিলতো, তাহলেই তা কিনতেন জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট।

উদ্যোক্তা তার তৈরীকৃত পোশাক ক্রেতার নিকট প্রদর্শন করছেন

টেইলর এর মাথায় প্রায়’শ আগুন ধরিয়ে দিত সেই অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া কিশোরীটি নিজের ডিজাইন বা কাটিং এর ধরন বুঝিয়ে আর এক একটি কাজ করিয়ে। প্রিয় টেইলর-মাস্টার মা কে বলেছিলেন এই মেয়ে একদিন ডিজাইনার হবেই। চলছে পোশাক নিয়ে কাজকর্ম এবং নিজের পোশাক বানিয়ে নেয়া টেইলরের কাছ থেকে।

ডিজাইনারের স্বপ্ন ফললো অনার্স প্রথম বর্ষে, ২০০৫ সালে। ১২০০ টাকা দিয়ে বান্ধবীকে পোশাক বানিয়ে দিয়ে লাভ হলো ১০০ টাকা। ফুচকা খাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। একটি পোশাক বানানোর পর আরও একটি এবং তার পর আরও একটি। সেই সময় এভাবে প্রায় ৫০ এরও বেশি পোশাক বানিয়ে ফেললেন জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট।

উদ্যোক্তার সফলতার গল্প দেখুন ইউটিউবে-দেখতে ক্লিক করুন

২০০৫ সালে, বন্ধুর ভাইয়ের বৌ-ভাতের শাড়িটি বানানোর এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আসলো জেসমিন কাওসারী জুলিয়েটের কাছে, এক গুরুভারের দায়িত্ব। দায়িত্ব টা শুধু গুরুভারের তা নয়, সফলতা আনার মত সুযোগও বটে। ভীষণ সুনাম কুড়ালেন জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট, লাভ এলো পাঁচ হাজার টাকা। একটি বড় মুনাফা বলে দিয়েছে জেসমিন কাওসারী জুলিয়েটকে একজন উদ্যোক্তা হবার কথা।

উদ্যোক্তা বার্তাকে জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট বলেন, “আমার কখনোই কমন কোনো ডিজাইনের পোশাক তেমন ভালো লাগতো না, শুধু অনন্যসুলভ ডিজাইন খুঁজে বেরাতাম। তাই চেষ্টা করতাম নিজে ডিজাইন করে পোশাক বানানোর। সেখান থেকেই আমার উদ্যোক্তা হবার ইচ্ছে মনে প্রাণে লালিত হয়েছিলো।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্ডার আসলো ১০টি শাড়ি, ১১ টি পাঞ্জাবীর। অসম্ভব অনুপ্রেরণা যোগালো অর্ডারটি তরুণ জুলিয়েটের কাছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন বরণের আরও একটি বড় অর্ডার এলো, ৩০ জনের একটি অর্ডার। সফলতাগুলো একে একে বলছিলো জেসমিন কাওসারী জুলিয়েটকে এগিয়ে যাবার কথা।

উদ্যোক্তার ভিন্ন ডিজাইনে তৈরী ওয়ান পিসের সমাহার

চলতে থাকে ডিজাইনের কাজ। অনার্স পাশের সাথে সাথেই বড় একটি বিয়ের অর্ডার আসলো ডিজাইনার জেসমিন কাওসারী জুলিয়েটের কাছে। আত্নবিশ্বাসী আর আপন কর্মে বলীয়ান হয়ে ওঠার এক তরুণ প্রাণ হয়ে উঠলেন যেন জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট, প্রায় এক লক্ষ টাকার অর্ডারটির ডেলিভারি দিয়ে।

একজন নারী উদ্যোক্তার এগিয়ে চলার পথ সবসময় মসৃণ  হয় না, তাকে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হয়। এমন ভাবেই এগিয়েছেন জুলিয়েট। এমনও সময় এসেছে ভেবেছেন আর বোধহয় কাজ করা হবে না। কিন্তু সকল বাধা কে জয় করে এগিয়ে গিয়েছেন জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট।

জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট বলেন, “২০১২ সালে সন্তান হবার পর, নিজেকে স্বাবলম্বী মা হিসেবে সন্তানের কাছে পরিচিত হবার বা পরিচয় দেবার তাগিদ অনুভব করি। সেই তাগিদ থেকেই আবারও নতুন কিছু করবার স্পৃহা জন্মেছিলো আমার।”

২০১৫ সালে, জোরেশোরে ফ্যাশন ডিজাইনার কাজে নেমে গেলেন জুলিয়েট। চাকরি নিলেন এক ফ্যাশন হাউসে। চাকরি করে জমালেন ৩৮ হাজার টাকা। নিজেই কিছু করব, নিজের পরিচয়ে পরিচিত হব এ কথায় বার বার নিজের আয়নায় বসে নিজেকে বলেছেন জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট। ২০১৬ সাল, ২০০০ স্কয়ার ফিটে নিজের ফ্যাক্টরি এবং ২০০ স্কয়ার ফিটে নিজের ছোট্ট একটি শো রুম ‘জুলিয়েট’স যিল ফ্যাশন হাউস’ সাজালেন জুলিয়েট। ৪ জন কর্মী, ৪ টি মেশিন। অর্ডার আসতে থাকে হুহু করে।

উদ্যোক্তা এবং তার জুলিয়েট’স যিল শো রুম

পাঞ্জাবী, শাড়ি, থ্রি পিস, পর্দা এবং নানান এক্সপেরিমেন্টাল কাজে নিজের সুনাম ছড়িয়ে দিলেন আত্নীয়, বন্ধু-বান্ধব, এলাকা এবং সারা দেশের চেনা জনদের কাছে চেনা মানুষের কাছে। অর্ডার বাড়তে থাকে, কর্মীর সংখ্যাও বাড়ে। নিয়মিত কর্মী কাজ করতে থাকে ১০ জন। উদ্যোক্তা জুলিয়েট শুধু মাত্র নিজের ফ্যাক্টরি বা নিজের শোরুম এর জন্য কাজ করছেন তা নয়, বাইরে থেকেও কাজ করিয়ে নিতে হয় বড় বড় অর্ডারে।

মেশিন কিনে দিয়েছেন বাইরে ৪ জন কর্মীকে। ১৪ জন কর্মী নিয়মিত কাজ এবং চুক্তি ভিত্তিক বড় কাজ আসলে বড় কর্মী দল কে বড় বড় কাজে একসাথে বসিয়ে দেয়া।
সবকিছু মিলিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে থাকেন জেসমিন কাউসারী জুলিয়েট। বড় বড় শো রুমে পোশাক দেন কিন্তু নিজে সবসময় যেন থাকেন একটা মূলধন বা মুনাফার ফাঁকে।

বর্তমানে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট থেকে রিক্রুটদের জন্য বেডশীট, পাঞ্জাবী প্রভৃতির অর্ডার পেতে থাকেন উদ্যোক্তা জুলিয়েট। এরই মাঝে তিনি নতুন উদ্যোগ নেন রাজশাহীর সকল স্কুল ড্রেস তৈরি করবার, সেই জন্য রাজশাহীর শালবাগান এলাকায় একটি নতুন টেইলার্সের দোকান নেন।

উদ্যোক্তার নানান ডিজাইনে তৈরী পাঞ্জাবির সমাহার

সম্প্রতি জেসমিন কাওসারী জুলিয়েটের পণ্য দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। ফ্রান্সে এক বাংলাদেশী প্রবাসী তিনি তার বুটিক হাউসের জন্য জুলিয়েটের সকল পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। ইন্ডিয়া, মালয়েশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া এবং জার্মানিতেও যাচ্ছে জুলিয়েটের পণ্য।

একজন বান্ধবীকে ১২০০ টাকার একটি ড্রেস বানিয়ে দিয়ে মাত্র ১০০ টাকা লাভ করে যাত্রা শুরু করেছিলেন অনার্সে পড়া এক তরুণী। আজ ২০১৮ সালে, ১০০০ এর ওপর ডিজাইন এবং লিস্টে ৪০০ জনেরও বেশি ক্রেতাদের নিয়ে প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা মূল্যমানের ব্যবসা পরিচালনা করছেন উদ্যোক্তা জেসমিন কাওসারী জুলিয়েট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here