হ্যামবার্গারের জন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়, এমন অদ্ভুত কথা কোনো দিন শুনেছেন? কিন্তু ১৯৬১ সালে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন ম্যাকডোনাল্ড-রেস্টুরেন্টের মালিক রেমন্ড আলবার্ট ক্রোক। শুধু হ্যামবার্গার বানানোর জন্যই একটা বিশ্ববিদ্যালয়। না হয় বার্গার খুবই ব্যবসাসফল একটি খাবার, তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বসে এটা নিয়ে শিখতে হবে?
হ্যামবার্গার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রে ক্রোকের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য সাধারণের থেকে অনেক আলাদা। তাঁর বিশ্বাস ছিল বার্গার ব্যবসা শুধু বার্গার বানানো নয়। বার্গার ব্যবসা করতে হলে ব্যবসার আদ্যোপান্ত জানতে হবে। তাই তিনি একটি ইনস্টিটিউট দিয়ে ফেলেন, যেখানে বার্গার ব্যবসার সবকিছু শেখা যায়। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি নিয়ে বের হন।
বিশ্ব উদ্যোগের ইতিহাসে রে ক্রোক খুব ব্যতিক্রমী একজন উদ্যোক্তা। সাধারণত সফল উদ্যোক্তা বলতে আমরা তাঁদের পাই, যাঁরা নিজেরাই নিজেদের ব্যবসা তৈরি করেছেন, এরপর তা সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ম্যাকডোনাল্ড রে ক্রোকের উদ্যোগ ছিল না। অর্থাৎ তিনি নিজে ম্যাকডোনাল্ড নন। তিনি কাজ করেছেন ম্যাকডোনাল্ডদের প্রতিষ্ঠানকে বড় করতে, এভাবেই তিনি ইতিহাসের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা হন।
ম্যাকডোনাল্ডের আসল প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন দুই ভাই, ম্যাক ম্যাকডোনাল্ড ও রিক ম্যাকডোনাল্ড। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বহুদিন কাজ করে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে অবশেষে ১৯৪৮ সালে ম্যাক ও রিক একটা হ্যামবার্গারের দোকান দেন, যার নাম ছিল ম্যাকডোনাল্ড। ১৯৫৪ পর্যন্ত ম্যাকডোনাল্ড ভাইদের সঙ্গে রে ক্রোকের কোনো ধরনের সম্পর্কই ছিল না। ক্রোক তখন কপাল ঘষছিলেন মিল্ক শেক মেশানোর মেশিন (ব্লেন্ডার) বিক্রেতা হিসেবে। ক্রোকের বয়স তখন ৫২ বছর। সে পর্যন্ত বলা যায় খুবই অসফল জীবন। ব্লেন্ডার বিক্রিতেও খুব সুবিধা করতে পারছিলেন না তিনি। নতুন বিক্রি বাদ, পুরোনোগুলোর অভিযোগ নিয়েই চাকরি যায় যায় অবস্থা।
এমন দুর্দিনে ক্রোকের পরিচয় হয় ম্যাকডোনাল্ড ভাইদের সঙ্গে। একদম কাজের সূত্রে। ম্যাকডোনাল্ডরা ক্রোকের প্রতিষ্ঠান থেকে ছয়টা ব্লেন্ডারের ফরমাশ দিয়েছিল। তা ডেলিভারি দিতে গিয়ে ক্রোকের চোখ চড়কগাছ। ছোট এক রেস্টুরেন্ট পথের মোড়ে, সেখান থেকে খাবার কিনে বসে খাওয়ার জায়গাও নেই, তা–ও রেস্টুরেন্টটিতে ভীষণ ভিড়। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়, এ রেস্টুরেন্টে খুব দ্রুত সময়ে খাবার পাওয়া যায়, ভিড় বলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এমন কোনো বিষয় নেই।
ক্রোক আগ্রহী হন ম্যাকডোনাল্ডদের বিষয়ে। কারণ, শুধু দ্রুত সময়ে খাবার তৈরি করাই নয়, ম্যাকডোনাল্ডরা তাদের খাবারের মানেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ক্রোক বাড়ি বন্ধক রেখে ম্যাকডোনাল্ডদের কাছে ফিরে আসেন তাদের ব্যবসার ফ্র্যাঞ্চাইজি ম্যানেজার হবেন বলে।
ক্রোকের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। পুরো আমেরিকায় ১ হাজারটি ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট করা, যেটার কর্মদক্ষতা এবং মান দুই–ই আসল ম্যাকডোনাল্ডের মতো হবে। ১৯৫৪ সালের সাপেক্ষে স্বপ্ন অনেক বড়ই ছিল। বিশেষ করে রে ক্রোকের জন্য। তাঁর না ছিল এ কাজে কোনো অভিজ্ঞতা, না আর্থিক সংগতি।
ম্যাকডোনাল্ডদের সম্মতি নিয়ে ১৯৫৫ সালে স্থাপিত হয় ম্যাকডোনাল্ড করপোরেশন। এরপর থেকেই শুরু রে ক্রোকের সফলতা। ভাবার কোনো কারণ নেই এ সফলতার গল্পে কোনো ব্যর্থতার ইতিহাস নেই। এত বড় একটা স্বপ্নের টানাপোড়েন বড়ই ছিল। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সমান মান ও দক্ষতা নিশ্চিত করাও ছিল কষ্টকর। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। তবু লেগে ছিলেন ক্রোক।
ম্যাকডোনাল্ড এত বড় হয় যে ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত ম্যাকডোনাল্ডের রেস্টুরেন্ট ছিল ৩৮ হাজার ৬৯৫টি। আর কর্মীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫ হাজার। ১৯৮৪ সালে যখন রে ক্রোক মারা যান, তখন তাঁত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ডলার।
ক্রোক তাঁর চেষ্টা, প্রজ্ঞা ও পরিশ্রম দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাধা নয় কোনো কিছুই। লেগে থাকলে সফল হবেনই হবেন। তো এত যাঁর প্রজ্ঞা, তিনি তো নিজেই একটা বিশ্ববিদ্যালয়। সেটুকু শেখাতে না হয় তৈরিই হলো একটা হ্যামবার্গার বিশ্ববিদ্যালয়। ক্ষতি কী? আর আগ্রহীরা রে ক্রোকের জীবনী নিয়ে করা সিনেমা দ্য ফাউন্ডার দেখে নিতে পারেন।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)