বিশ্ববিখ্যাত ফোর্ড গাড়ির কথা কে না শুনেছে? আমেরিকার শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড ‘ফোর্ড মোটর কোম্পানি’র প্রতিষ্ঠাতা।
কিশোর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গ্যারেজে কাজ করা ফোর্ড জীবনে বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনকে অনুসরণ করতেন। আর গ্যারেজে বসেই অটোমোবাইল প্রকৌশলকে নিজের মগজে গেঁথে নেন। একসময় ঝুঁকি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ফোর্ড মোটর কোম্পানি নামের প্রতিষ্ঠানটি। মোটর গাড়ির আবিষ্কারক না হলেও তিনিই প্রথম মোটর গাড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেন। তিনি আমেরিকার মধ্য আয়ের মানুষদের কথা চিন্তা করে নির্মাণ করেন ফোর্ড গাড়ি।
১৫৯ বছর আগে, ১৮৬৩ সালের ৩০ জুলাই আমেরিকার মিশিগানে গ্রিনফিল্ড টাউনশিপের একটি খামারবাড়িতে উইলিয়াম ও মেরি ফোর্ড দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন হেনরি ফোর্ড। তিনি ছিলেন একজন কৃষকের সন্তান। তার বাবাও চেয়েছিলেন হেনরি একজন কৃষক হোক।
ফোর্ডের বাবা বাল্যকালে তাকে একটা পকেট ঘড়ি দেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ঘড়িটি বারবার নষ্ট করতেন আবার সেটা ঠিক করতেন। এটা ছিল ফোর্ডের কাছে একটা খেলার মতো। এলাকার কারও ঘড়ি সারানোর দরকার হলে ডাক পড়তো ফোর্ডের।
১৮৭৬ সালে হেনরির মা মারা যান। মায়ের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। বেশ কিছুদিন ভবঘুরের মতো দিনযাপন করে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। পাশাপাশি কৃষি কাজকে নিজের পেশা হিসেবে নিতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দেন।
১৮৭৯ সালে তিনি বাড়ি ছাড়েন এবং ডেট্রয়েটে জেমস এফ ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ মেকানিক হিসেবে যোগ দেন। মূলত সেখানেই হেনরির যন্ত্রপাতি নিয়ে জীবন শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহে বেতন ছিল মাত্র আড়াই ডলার। কিন্তু শেখার তাগিদের কারণে তার কাজের প্রতি আবেগ কখনও কমেনি। টাকার অভাব মেটাতে ঘড়ি সারানোর জন্য রাতে কাজ শুরু করেন। যার কারণে তিনি প্রতি সপ্তাহে দুই ডলার অতিরিক্ত আয় করতে পারতেন। তিন বছরের প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন।
যন্ত্রকৌশল রপ্ত করে হেনরি বাড়ি ফেরায় তার বাবা কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিলেন। বাড়ি ফেরার পর হেনরি যখন বাবার সঙ্গে খামারে কাজ করা শুরু করেন, তখন পিতা উইলিয়াম ফোর্ড ছেলের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। মূলত হেনরি বাড়ি ফিরেছিলেন গোপন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। ডেট্রয়েটে দুটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর হেনরি সিদ্ধান্ত নেন কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। আর সেই সুবাদে তিনি বাড়ি ফিরে ওয়েস্টিংহাউসের বহনযোগ্য বাষ্পীয় ইঞ্জিন পরিচালনার কৌশল শিখতে কাজে নেমে পড়েন। পরবর্তীকালে তার কারিগরি দক্ষতা স্বীকৃতি পায় এবং ওয়েস্টিংহাউস কর্তৃপক্ষ তাকে ডেকে নিয়ে নিয়োগ দিয়েছিল।
হেনরি ফোর্ড তার কারিগরি দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার কারণে খুব অল্প বয়সে ভালো সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ১৮৯১ সালে তাকে নিয়োগ দেয় এডিসন ইলেকট্রিক ইলুমিনেটিং কোম্পানি। সেখানে তার পদবি ছিল নাইট ইঞ্জিনিয়ার। তিনি সেখানে খুব কৌতূহলের সঙ্গে কাজ করেন এবং তড়িৎকৌশল নিয়ে জানার সুযোগ পান। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে ভুল করেননি তিনি। মাত্র চার বছরে হেনরি তার কাজের গুণে পদোন্নতি লাভ করেন এবং প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রকৌশলীর পদে অধিষ্ঠিত হন।
সেসময় কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে হেনরি কোয়ার্ডিসাইকেল নামের চার চাকার যান তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৯৩ সালে ফোর্ড প্রথম স্বয়ংক্রিয় গাড়ি তৈরিতে সফল হন। এটি নিয়ে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মালিক টমাস এডিসনের সঙ্গে দেখা করেন। এডিসন তার আবিষ্কারকে স্বাগত জানান এবং এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেন। টমাস আলভা এডিসনের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে হেনরি অটোমোবাইল নিয়ে আরও মনোযোগী হয়ে ওঠেন এবং নিজের মডেলটিকে আরও উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৮৯৮ সালে হেনরি তার দ্বিতীয় যানটি তৈরি করতে সক্ষম হন। সেটি ছিল তার তৈরি প্রথম যানের চেয়েও উন্নত ও নিরাপদ।
ফোর্ড একটি অটোমোবাইল কোম্পানি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল মূলধন। সেখানে ভাগ্যে কিছুটা তার ওপর সহায় হয়, ডেট্রয়েটের বিশিষ্ট শিল্পপতি উইলিয়াম এইচের সহযোগিতায় ডেট্রয়েট অটোমোবাইল কোম্পানি যাত্রা শুরু করে। এটি ছিল তার স্বপ্নপূরণের দিকে প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু পুরনো মডেলের গাড়ি কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে ফোর্ডের কোম্পানি লোকসানে যেতে শুরু করে। স্টেকহোল্ডাররা তাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ১৯০১ সালের জানুয়ারিতে ডেট্রয়েট অটোমোবাইল কোম্পানি ভেঙে দেয় স্টেকহোল্ডাররা। এভাবে হেনরি ফোর্ড তার স্বপ্নপূরণে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা প্রথম পর্যায়েই ভেস্তে যায়। তার প্রথম অটোমোবাইল কোম্পানির এই ভাগ্য ফোর্ডের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল।
প্রথম কোম্পানির ব্যর্থতা থেকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে হ্যারল্ড উইলসের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ফোর্ড একটি রেসিং কার তৈরির চেষ্টা চালান। রেসিং গাড়ি নাম অর্জন করলেও গাড়িটি সাধারণ মানুষের কাছে অকেজো ছিল। যে কারণে ফোর্ডের গাড়ি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফোর্ড এবং কোম্পানির অংশীদারদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিতে শুরু করে। ফোর্ডের কাজ তদারকির জন্য সুপারভাইজার বানিয়ে এম লাইল্যান্ডকে কোম্পানিতে আনা হলে রাগান্বিত হয়ে ফোর্ড কোম্পানি ত্যাগ করেন।
দ্বিতীয় ব্যর্থতার পর লোকজন বলতে শুরু করে যে হেনরি ফোর্ড তার দুটি সুবর্ণ সুযোগ হারানোর পর শেষ হয়ে গেছেন। কিন্তু ফোর্ড হাল ছাড়েননি। তাই আবার রেসিং কারের দিকে ঝোঁকেন। তিনি রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য ৮০ প্লাস হর্স পাওয়ার রেসিং কার তৈরির লক্ষ্যে সাবেক রেসিং সাইক্লিস্ট টম কুপারের সঙ্গে এক হন। রেসার বার্নি ওল্ডফিল্ড সেই গাড়িটি রেসে নিয়ে যান এবং সাফল্যের পতাকা দেখিয়ে দেন। এই সাফল্যের পর লোকজন আবার ফোর্ডের গাড়ির ওপর আস্থা রাখতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মধ্যে আমেরিকার অর্ধেকেরও বেশি গাড়ি ছিল ফোর্ডের। সেই বছরের ডিসেম্বরে হেনরি ফোর্ড তার ছেলে এডসেল ফোর্ডকে কোম্পানির সভাপতি করেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে তার পরিবার ফোর্ড মোটর কোম্পানির সম্পূর্ণ মালিকানা গ্রহণ করে। ‘মডেল-টি’ গাড়ির পর এটিকে ‘মডেল-এ’ গাড়িতে পরিণত করার জন্য পুনরায় ডিজাইন করা হয়, যা জনপ্রিয়তার রেকর্ডও তৈরি করে। এভাবে হেনরি ফোর্ড গাড়ির জগতের জনক হয়ে যান।
মাত্র ২৮,০০০ ডলার পুঁজি নিয়ে হেনরি ফোর্ড গড়ে তোলেন ফোর্ড মোটর কোম্পানি। দিনে দিনে গড়ে ওঠে ফোর্ড এয়ারপ্লেন কোম্পানি।
বলা হয়ে থাকে, হেনরি ফোর্ড যদি প্রথম দুটি ব্যর্থতার পর হাল ছেড়ে দিতেন, তাহলে তিনি কখনোই সাফল্যের উচ্চতায় পৌঁছাতে পারতেন না। তিনি তার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করে ফের এগিয়ে গেছেন এবং বিফলতার পথ পেরিয়ে আজ তিনি ‘ফাদার অব কারস’নামে বিশ্বে অমর।
কর্মজীবন ছেড়ে অবসরে যাওয়ার পর ১৯৪৭ সালের ৭ এপ্রিল ৮৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান কালজয়ী এই প্রকৌশলী।
সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা