সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণি, ডানা মেলে খেলার মাঠে ছুটে বেড়াবার সময়। জীবনবোধের চিন্তাগুলো সেই বয়সে কাউকে খুব একটা স্পর্শ করে না। কিন্তু সেই অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই স্বর্ণা পড়ার টেবিলে বসে ভাবতেন ‘আমি এমন কিছু করবো যাতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।’
বয়সটা ছিল খুবই কম, তাই হয়তো চিন্তাটা খুব বেশি জোরালো ছিল না। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে হোসনা এমদাদ তার সেই শৈশবের ভাবনার পথেই পা বাড়িয়েছেন।
পারিবারিক আর্থিক সঙ্কটের কারণে স্বর্ণা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তখন থেকেই সবসময় চিন্তা করতেন নিজস্ব উদ্যোগে কিছু একটা করবেন যা দিয়ে তিনি তার পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতে পারবেন। এমন চিন্তাধারা থেকেই মেধাবৃত্তি হিসেবে ডাচ বাংলা ব্যাংক থেকে স্নাতক পর্যায়ে যে টাকা পেতেন তা জমিয়ে ৪,০০০ টাকা দিয়ে স্নাতক ২য় বর্ষে তিনি তার উদ্যোগ শুরু করেন খুবই সীমিত পরিসরে। উদ্যোগকে বড় পরিসরে নেওয়ার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য চাকরি করেন বেশ কিছুদিন।
বাবা মো: এমদাদ হোসেনের এনজিওর চাকরির কারণে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে মেয়ে হোসনা এমদাদ স্বর্ণার। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রিন্টমেকিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। লেখাপড়া শেষে কর্মজীবন শুরু করেন ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে। কে ক্রাফট এবং স্নোটেক্স গ্রুপের সারা লাইফস্টাইলে বেশ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতায় দেশীয় পোশাক শিল্প সম্পর্কে বিশদ ধারণা পান তিনি।
তিনি উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, “বর্তমানে আমার মূল পণ্য হলো হস্তনির্মিত গহনা। গহনা নিয়ে কাজ করার পেছনে কারণ হচ্ছে আমাদের নান্দনিক রুচিবোধ, যা আমাদের মনোজগতকে প্রফুল্ল রাখে। এ কারণেই গহনা নিয়ে কাজ করা এবং সেই সাথে আমি সবসময় এটা মনে রাখি যে প্রাকৃতিক সম্পদকে ধারণ করে ও রক্ষা করে কাজ করা উচিত। এ কারণে আমার পণ্যে আমি প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আমার মূল উপকরণ রেশম সূতা, পাট, কাঠ, মেটাল, বিভিন্ন ফলের বীজ ইত্যাদি। সেইসাথে আছে বাংলাদেশের তাঁতিদের বোনা হ্যান্ডলুম তাঁতের শাড়ি, হ্যান্ডপেইন্টের শাড়ি, ব্লকের কটন থ্রি পিস, পাঞ্জাবি। আমি যন্ত্রের ব্যবহার থেকে জনবল বা লোকবল ব্যবহার করতে চাই কারণ যখন একটি পণ্য হাতে বানানো হয় সেটা পরিবেশবান্ধব হয়ে যায় অনেকটাই। যন্ত্রের ব্যবহার আমরা যতটা কমাতে পারি সেটার চেষ্টাই করি সবসময়।”
স্বর্ণা তার উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘ক্রিসতাং’। এটি একটি মারমা শব্দ। ক্রিস হলো এক ধরনের ছোট পাখি আর তাং মানে পাহাড়। ‘ক্রিসতাং’ অর্থ ছোট পাখির পাহাড়। চিম্বুক রেঞ্জের সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে পরিচিত এই পাহাড়টি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। পরিবেশকে ভালোবেসে কাজ করছেন উদ্যোক্তা, তাই তিনি তার উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘ক্রিসতাং’। তার প্রতিষ্ঠানে সার্বক্ষণিক কর্মী আছেন চারজন। এছাড়াও গ্রাম থেকে অনেক সময় কাজ করিয়ে আনেন। ঢাকার ভেতরে প্রডিউসারদের দিয়েও পণ্য তৈরি করে থাকেন তিনি। কারখানা বলতে নিজের বাসার একটি রুমকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। সেখানেই চলে তার কর্মযজ্ঞ।
দেশের ৬৪ জেলাসহ দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে ক্রিসতাং এর পণ্য। নিয়মিত ভাবে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকাতেও যাচ্ছে। মাসে গহনার উৎপাদন হয় ২৫০ থেকে ৩০০ পিস এবং অন্যন্য পণ্য উৎপাদন হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ পিস। প্রতি মাসে বিক্রি ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার মতো।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, “আমি এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ দেশীয় পণ্যের ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যার শ্রমশক্তি হবে আমাদের গ্রামের মানুষ।”
সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা