২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর ধরে উদ্যোক্তা সাহিদা সরকার পাটের উপর সুক্ষ্ম ফেব্রিক দিয়ে জাতির পিতা শেখ মুজিবকে নিয়ে তৈরি করেন পাটের প্রতিকৃতি চিত্র। যা বিভিন্ন মেলা এবং প্রদর্শনীতে সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নিকট বেশ প্রশংসিত হয়। অনেক সম্মানিত ব্যাক্তিবর্গ তার তৈরি পাটের প্রথম প্রতিকৃতি চিত্রটি কিনতে চান কিংবা উপহার হিসেবে দিতে বলেন কিন্তু উদ্যোক্তা তার সৃষ্টি মুজিব প্রতিকৃতি চিত্রটি একমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিতে চান।

এছাড়াও শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ সালে তিনি পাট দিয়ে শেখ মুজিবের লোগোর প্রতিকৃতি চিত্র তৈরি করেন এবং তা প্রদর্শনীর পর সেখান থেকে ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধাদের সম্মানে ৫৫০ পিস স্মারক তৈরির অর্ডার পান তিনি।

উদ্যোক্তা সাহিদা সরকার রত্নার কর্ম জীবন শুরু সেই ছোট্টবেলা থেকে। নরসিংদী জেলার সদর উপজেলায় শিলমান্দী ইউনিয়নে তার জন্ম। তার বয়স যখন তিন বছর তখন তাঁর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রথমে যক্ষ্মা তারপরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। আত্মীয়-স্বজনরা সবাই দূরে সরে যায়। সেই সময় তার বড় ফুফু তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার নাম করে এক বাসায় কাজের জন্য নিয়ে আসে। সেখান থেকে এক সপ্তাহ পর চলে আসে রত্না। তখন তিনি ভাবলেন কিছু না কিছু করতে হবে। নিজের উপার্জনের রাস্তা বেছে নিলেন সুই সুতার মাধ্যমে। ব্রাক স্কুলে পড়াকালীন সময়ে গ্রামের এক ভাবীর কাছ থেকে মেশিনে সেলাইয়ের হাতে খড়ি হয় রত্নার।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। শুরু হয়
এক নতুন অধ্যায়। দিন রাত এক করে তিনি শুধু কাজ করে যেতেন। থানা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তিন বছরের কন্টাকে কাজ করেছেন যখন তিনি চতুর্থ শ্রেনীতে পড়েন। চতুর্থ শ্রেনীতে পড়াকালীন বিয়ে হয়ে যায় রত্নার।
তিন মাস অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে তিনি পালিয়ে আসেন সেখান থেকে।

মনোবল শক্ত করে শুরু করেন তার সেলাইয়ের কাজ। সেই সময় তিনি এলাকার বাজারে এক টেইলার্সের দোকানে কাজ করতেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে যুক্ত থেকে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গেছেন তিনি।এমডিএস নামে একটা এনজিওর সাথে কাজ করেছেন।

২০০৩ সালে “হাতে বুনানো বাংলাদেশ” নামক ট্রেনিং এ অংশ নেন। ৩ মাস সোয়েটার এর উপর ট্রেনিং নেন সামান্থা মোর্শেদের নেতৃত্বে। সেখানে তিনি ৭৩ জনের মধ্যে গ্রেড ১ এর সার্টিফিকেট পান এবং সেই সাথে চাকরি পান ট্রেইনার পদে। এছাড়াও
নেদারল্যান্ড ভার্সিটির প্রফেসর জুজু ম্যানান বিবি উনার কাছ থেকে সোয়েটার ক্রাফটিং এর উপর ট্রেনিং নেয়ার সুযোগ পান।

তিনি বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ পান।
ড. ইউনুস এর মঙ্গা প্রজেক্টে প্রজেক্ট ইনচার্জ হিসেবে কাজ করেন কুড়িগ্রামে ২০০৫ সালে তখন তিনি ১৩/১৪ বছর বয়সের একজন কিশোরী। পরবর্তীতে মাজেদ হোসাইন খান এর তত্ত্বাবধানে প্যান্যাস নিটেড ক্রিয়েশন এ হ্যান্ড ক্রুশের কো অর্ডিনেটর হিসেবে ৩ মাস কাজ করেন।

জীবনের বিভিন্ন বাধা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে একের পর এক কাজ করে গেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নিজ বাসাতেই কন্টাকে কাজ করেছেন। পারিবারিক অসামঞ্জস্যতা, ব্যর্থতা আর হতাশায় কখনো কখনো আত্নহত্যা করবার মত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু পরক্ষণে নিজেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। শারীরিক এবং মানসিকভাবে একাই লড়াই করে যাচ্ছেন রত্না। পরিবার পরিজন থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা তিনি কখনোই পাননি। ২০১০ সালে তার টেইলার্সের বিজনেসে একটি বড় ধরনের ক্ষতি হয়। ২০১১ সালে তাঁর জরায়ু অপারেশন হয়। এরপরেও তিনি বিভিন্ন এনজিও, হারবাল কোম্পানি এমনকি সৌদি আরবেও গিয়েছিলেন তিনি কাজের সুবাদে।

অনেকদিন মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য কাজ থেকে বিরত থাকেন। ২০১৭ সালে নিউ বর্ন বেবিদের জন্য কাঁথা তৈরি করে যা ছিল খুবই টেকশই এবং সদ্যজাত সন্তানের জন্য খুবই আরামদায়ক।
মাত্র ১২৬ টাকা দিয়ে তিনি একটি কাঁথা তৈরি করেন এবং সেখান থেকে ৫০/১০০ পিস করে কাঁথার অর্ডার আসে। ২০১৯ সালে নরসিংদীতে ফুল জুট এন্ড হ্যান্ডিক্রাফট এর নামে একটি ট্রেড লাইসেন্স করেন। তখন থেকে তিনি নিজ নামে কাজ শুরু করলেন৷ পরিবার থেকে কোনো প্রকার সহযোগীতা না পাওয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোনের মাধ্যমে তিনি তার হাতের কাজগুলো করে থাকেন। সুই সুতায় তিনি স্বপ্ন দেখেন। তাই তো সুই সুতা দিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
টেইলারিং এর পাশাপাশি ক্রুশি,উল,বেবী কাথা পাটের উপরে সুতা দিয়ে প্রতিকৃতি চিত্র,পাটের ব্যাগ
গামছাশাড়ী,পান্জাবী, থ্রি পিছ,ফতুয়া, টপস,পাট ও কড়ির গয়না,পাটও বস্র দিয়ে আরো নানা রকম কাজ করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার পন্য পৌঁছে যাচ্ছে। সেই সাথে দেশের বাইরেও তার গামছাশাড়ী, ফতুয়া বেশ প্রশংসা পেয়েছে। হস্ত শিল্প এসোসিয়েশন, নরসিংদীতে বইমেলা এবং নরসিংদী এসএমই পণ্য মেলায় অংশগ্রহন করেন। ডিসি এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়েছে তার পন্য গুলো। জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ হস্তশিল্প এসোসিয়েশন এর ক্ষুদ্র কুটির শিল্প প্রদর্শনীতে সেরা ১০ এর তালিকায় ছিলেন তিনি।

২০২০ সালের অক্টোবরে তার পিত্ত থলিতে একটি মেজর অপারেশন হয়। এছাড়াও বর্তমানে কান এবং গলায় ইনফেকশন ধরা পড়ে। একমাত্র মেয়েকে সাথে নিয়ে শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থ্যতার মধ্য দিয়েও তিনি তার স্বপ্নকে লালন করছেন। তিনি বেঁচে থাকতে চান তার কর্মের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ আলাচারিতায় উদ্যোক্তাবার্তাকে তিনি বলেন, “পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ।পাট যেমন বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেয় ঠিক তেমনি আমি পাট নিয়ে কাজ করে আমি আমার পরিচয়কে তুলে ধরতে চাই এবং সেই সাথে দেশের পাটকে কাজে লাগিয়ে দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে চাই”।

পাটের উপর সুতা দিয়ে কাজ করে বিভিন্ন সম্মানিত ও গুণীজনদের প্রতিকৃতি চিত্র তৈরি করে তিনি একটি এক্সিবিশন করার সিদ্বান্ত নেন। কাজকে ভালোবেসে সততার সাথে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই এমনটাই মনে করেন উদ্যোক্তা সাহিদা সরকার রত্না।

সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তাবার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here