মাত্র ৫৬০০ রুপি থেকে ১০ টি জেট বিমানের মালিক কনিকা তেকরিওয়াল

0

দৃঢ় ইচ্ছা আর প্রচেষ্টা মানুষকে তার স্বপ্নপূরণের পথে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে, স্বপ্নবাজ মানুষ এর প্রমাণ দিয়েছে বারবার। ক্যানসারকে জয় করে মাত্র ৩২ বছর বয়সেই ১০টি ব্যক্তিগত জেট বিমানের মালিক হয়েছেন তেমনই এক স্বপ্নবাজ তরুণী। ভোপালের জওহরলাল নেহরু সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি লন্ডনের কভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ভোপালের একটি মারওয়ারি পরিবারে বড় হয়ে ওঠা। ব্যবসা যার রক্তেই ছিল। ছোট থেকেই ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন নিজে কিছু করার। তার আগ্রহের বিষয় ছিল উড়োজাহাজ।

বলছিলাম, ভারতের প্রথম প্রাইভেট জেট ভাড়া দেওয়া সংস্থা বা ‘আকাশের উবার’ নামে খ্যাত ‘জেটসেটগো’-এর উদ্যোক্তা ও সিইও ভোপালের তরুণী কণিকা তেকরিওয়ালের কথা।

ওড়ার ইচ্ছেটা ছিল বরাবরের। প্রতিবন্ধকতা শব্দটা নিজের অভিধানে কখনও খুঁজে পাননি তিনি। বাধা ছিল, বিপত্তিও ছিল একশো’টা। কিন্তু দমে যাওয়া কাকে বলে শেখেননি কোনও দিন। ক্যান্সার নামটা শুনলে যেখানে লোকে ধরেই নেয় আর ক’দিনের মধ্যেই শেষ হবে জীবন, ঠিক সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা শুরু করেছিলেন কণিকা । ‘জেট সেট গো’ বলে উড়ছিলেন নীল আকাশে।

কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই অ্যাভিয়েশন সেক্টরে কাজ করতে শুরু করেন। যারা প্রাইভেট জেটের মালিক, তাদের খবরাখবর নেওয়া, কেউ কিনতে চাইলে তাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করাই ছিল তার কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, শুধু মেইনটেন্যান্স আর ফ্লাইটের খরচের কারণে লোকে প্রাইভেট জেট কিনতে পারেন না। তখন তিনি ভাবলেন, যারা ফ্লাইট চার্টার করতে চায় তাদের সঙ্গে চাটার্ড ফ্লাইট অপারেটরদের সংযোগ ঘটিয়ে দেবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। মাত্র ২২ বছর বয়সে অ্যাভিয়েশন সেক্টরের চাকরি ছেড়ে তিনি অ্যাভিয়েশন স্টার্টআপ শুরু করেন। মাত্র ৫ হাজার ৬০০ রুপি নিয়ে শুরু হয় তার স্টার্টআপ। প্রথম ছয় মাস একজন ক্লায়েন্টও পেলেন না। টাকা ধার করে চালিয়ে যেতে থাকলেন তার স্বপ্নের ব্যবসা।

এমন সময় কো-ফাউন্ডার হিসেবে যুক্ত হলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট সুধীর পার্লা। কণিকা লোকজনকে প্রাইভেট প্লেন কেনার পরামর্শ দিতে শুরু করলেন। এক গণমাধ্যমে তিনি জানান, যখন ট্রেড লাইসেন্স করতে যান তখন তাকে সেটা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। বলা হয়, ‘অ্যাভিয়েশন’ ব্যবসা করতে হলে ব্যক্তিগত প্লেন লাগবে। তিনি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন, তিনি শুধু ট্রেডিং করবেন, প্লেন ওড়াবেন না। তবু তারা গো ধরে বসে থাকেন। তিনিও হাল ছাড়েননি। সফলতার পথ যে অতটা মসৃণ হয় না, তা জানতেন কণিকা । ধীরে ধীরে তার দিন ঘুরতে শুরু করল।

নিজের স্বপ্নপূরণের পথে যখন সবেমাত্র হাঁটতে শুরু করেছেন, তার কিছুদিন পরেই কণিকার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। বয়সটা তখন মাত্র ২২। চিকিৎসক জানান, ‘সেকেন্ড স্টেজ, খুব বেশি দিন বাঁচবেন না’। সে দিনই ওই ডাক্তারকে গুড বাই জানিয়েছেন কনিকা। তখন তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন ‘৪০তম জন্মদিনে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করব’। ন’মাস ধরে কেমো চলেছিল। যন্ত্রণায় সোজা হতে পারতাম না। কিন্তু লড়াই ছাড়িনি। ক্যানসার নিয়ে কথা বলতাম, চর্চা করতাম। এতেই মনোবল ফিরে পেয়েছিলাম অনেকটা। এক বছর পর সুস্থ হয়ে আবার শুরু করেন কাজ। সুস্থতার জন্য ততদিন নিজেকে ম্যারাথন দৌড়বিদ হিসেবেও তৈরি করে ফেলেছেন কনিকা।

প্রাইভেট বিমান পরিষেবাকে আরও সহজলভ্য, স্বচ্ছ, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং সবার জন্য দক্ষ করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে জেটসেটগোর যাত্রা শুরু হয়েছিল। ক্যানসারকে হারিয়ে সেই পথ চলা শুরু। ছোটবেলার নেশা পেশায় পরিণত হল ‘জেট সেট গো’-র ডানায় ভর করে। ট্যাক্সি, ওলা বা উবরের মতোই এখানে ভাড়া করা যায় জেট প্লেন। গ্যাঁটের কড়ি খরচা করলেই আকাশপথে উড়িয়ে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে এই জেট বিমানগুলি। ভারত ছাড়াও নিউইয়র্ক, দুবাই ও আরও বিভিন্ন দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিষেবা দিয়ে থাকে কনিকার জেট সেট গো। একসময় কাস্টমারদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে শুরু করলেন ‘জেট সেট ওয়েড’। ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ে অন্য মাত্রা যোগ করল এই নতুন ব্যবস্থা। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল ‘জেট সেট রেসকিউ’। কোনও সঙ্কটকালীন অবস্থায় উদ্ধারকার্যে অংশ নিতে পারে এই জেট বিমানগুলি। উন্নত লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের পাশাপাশি এতে রয়েছে এমারজেন্সি মেডিক্যাল পরিষেবা। পাশাপাশি ‘জেট সেট গো’-তে রয়েছে ‘জেট সেট যাত্রা’। বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি এই জেট বিমানগুলি।

২০১৬ সালে ফোর্বসের অনূর্ধ্ব ৩০-এর অ্যাচিভার্স অব এশিয়া তালিকায় নাম তুলেছেন কনিকা । বিবিসির উদ্যমী নারীদের তালিকায় আছেন সাত নম্বরে। পেয়েছেন ‘ন্যাশনাল এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ , ও্যার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইয়াং গ্লোবাল লিডার সহ বেশ কয়েকটি পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কনিকা। এ ছাড়া মাত্র ১০ বছরে ভারতের কনিষ্ঠতম সেল্ফ মেইড মহিলা ধনীদের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি। ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেসের তথ্যমতে ১০টি জেট বিমানসহ কনিকার সম্পদের পরিমাণ ৪২০ কোটি রুপি।

‘‘জীবনের প্রত্যেকটা ‘না’ আসলে ‘হ্যাঁ’-এর পথ প্রশস্ত করে। ‘না’ গুলোকে ‘হ্যাঁ’ করতে করতেই একটা সফল জীবনের পথে এগিয়ে চলেছেন, ক্যানসারকে হার মানানো ভারতীয় উদ্যোগপতি মহলে দ্য স্কাই কুইন খ্যাত উদ্যমী তরুণী কণিকা তেকরিওয়াল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here