মাত্র ১৩ বছর বয়সেই উদ্যোক্তা প্রতিভার পরিচয় দেন

0

ভাল স্পিকার বা সাউন্ড সিস্টেমের কথা ভাবলেই প্রথমেই মাথায় আসে বোস (Bose) ব্র্যান্ডের নাম। বর্তমানে সাউন্ড ইন্ডাস্ট্রির একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে বোস। বাড়িতে বা গাড়িতে সাউন্ড সিস্টেমে দেখা যায় বোসের নাম। আপনারা জেনে অবাক হবেন এক বাঙালিই তৈরি করেছিলেন এই ব্র্যান্ড? সাউন্ড সিস্টেমের দুনিয়ায় তাক লাগানো সেই বাঙ্গালির নাম অমর বোস।

সুস্পষ্ট শব্দের ছোট আকারের রেডিও এবং বিমানযাত্রায় ব্যবহূত শ্রুতিকটু আওয়াজমুক্ত হেডফোনের জন্য বোস করপোরেশনের রয়েছে সুনাম। প্রতিষ্ঠানটির পণ্যসমূহের মধ্যে আরও রয়েছে হোম থিয়েটার উপকরণ ও কম্পিউটার স্পিকার।   

অমরের বাবা ননীগোপাল বসু ছিলেন ভারতীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন তিনি। ব্রিটিশদের অত্যাচারে দেশ ছেড়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখানে বিয়ে করেন একজন আমেরিকান স্কুলের শিক্ষিকাকে। ১৯২৯ সালে ফিলাডেলফিয়াতে জন্ম হয় অমর বোসের।
১৩ বছর বয়সে এবিংটন সিনিয়র হাইস্কুলে পড়ার সময় অমর আর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একটি ‘হোম সার্ভিস’ দল গঠন করেন। তাঁদের কাজ ছিল বাসায় বাসায় গিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া রেডিও ও খেলনা ট্রেন ঠিক করা। আর এ কাজ করতে করতে অমর ইলেকট্রনিকস নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অমরের বাবার ব্যবসা একটি বড় ধরনের ধাক্কা খায়। অমরদের পরিবার কঠিন অর্থাভাবে পড়ে যায়। তখন অমর তাঁর বাবাকে পরামর্শ দেন তিনি যেন বিভিন্ন দোকানে ‘এখানে নষ্ট রেডিও মেরামত করা হয়’ এই রকম একটি কাগজ ঝুলিয়ে দিয়ে আসেন। ননী গোপাল ছেলের ইলেকট্রনিকসের ক্যারিশমা জানতেন। দিনভর বাবা ননী গোপাল দোকান থেকে দোকানে ঘুরে নষ্ট রেডিও জোগাড় করে আনতেন। স্কুল থেকে এসে বাসার বেজমেন্টে বসে সেগুলো সারাই করতেন অমর বসু।

মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তার উদ্যোক্তা প্রতিভার পরিচয় দেন। তিনি তার স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে মডেল ট্রেন ও হোম রেডিও মেরামতের একটি ছোট পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বযুদ্ধের প্রায় অনেকটা সময় অমরের এই আয় তাঁদের পারিবারিক পতন রোধ করতে সহায়তা করে।

ছেলের এসব প্রকৌশল-ব্যু্ৎপত্তি দেখে ননী গোপাল বসু অমরকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উন্নত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য মনস্থির করেন। ১৯৪৭ সালে অমর বসু ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) ছেলেকে ভর্তি করান। স্নাতক পাশ করার পর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন অমর। ১৯৫৬ সালে একটি হাই-এন্ড স্টেরিও স্পিকার সিস্টেম কিনেছিলেন তিনি। কিন্তু মিউজিক সিস্টেমে গান শুনে মন ভরেনি অমরের।
অমর বসু খেয়াল করলেন বড় বড় হলঘরে একজন শ্রোতা মঞ্চের যে শব্দটি শুনতে পান তার ২০ শতাংশ মাত্র তিনি সরাসরি শোনেন। বাকি ৮০ শতাংশই বিভিন্ন স্থানে ধাক্কা খেয়ে শ্রোতার কানে পৌঁছে। এই ধারণা থেকেই ‘সাইকো-অ্যাকোয়াস্টিক’ নামে শব্দবিজ্ঞানের নতুন এক শাখার জন্ম হয়। এই তত্ত্বের উপর নির্মিত ২২০১ স্পিকারই ছিল প্রথম ডিরেক্ট বা রিফ্লেক্টিং স্পিকার।

নিজের মনমতো স্পিকার বানানোর উদ্দেশ্যে ১৯৬৪ সালে অমর বসু প্রতিষ্ঠা করেন বোস করপোরেশন (Bose Corporation)।  বাজারের সবচেয়ে দামি স্পিকারের ওপর রাগ করার ১২ বছর পর তিনি একটি নতুন স্পিকার বানালেন। ১৯৬৮ সালে বাজারে আসে ‘বোস ৯০১ ডিরেক্ট/রিফ্লেক্টিং’ স্পিকার সিস্টেম। স্পিকারটি আসলে অনেকগুলো ছোট ছোট স্পিকারের সমষ্টি। ঘরের দুই কোনায় দুটি স্পিকার বসিয়ে দিয়ে কনসার্ট হলের মতোই আমেজ পাওয়া গেল। ওই সাউন্ড সিস্টেমটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। তার পর থেকেই বাজারে আসতে থাকে সংস্থার তৈরি নানা ধরনের সাউন্ড সিস্টেম। সেই থেকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠ স্পিকার সিস্টেমগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠানই তৈরি করে।

১৯৮০ সালে তিনি খেয়াল করলেন গাড়ি যখন হঠাৎ করে ব্রেক করে, তখনই একটা ঝাঁকুনি লাগে। গাড়ির শক এবজরভার মোলায়েম নয় বলে সেটা হয়। সেই ১৯৮০ সাল থেকে তিনি একটি মোটর ডিজাইনের কাজ করেছেন, যা মেকানিক্যাল শক এবজরভারকে প্রতিস্থাপন করবে। পরবর্তী ২৪ বছরে এই গবেষণায় বোস করপোরেশন ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন (১৭০ কোটি) ডলার খরচ করেছে। এখন চালু হয়েছে ‘বোস শক এবজরভার সিস্টেম’।

স্পিকার বিক্রি করে যে লাভ হচ্ছিল, তার একটা বড় অংশই অমর বোস খরচ করেন গবেষণার উপরে। আরও ভাল স্পিকার কীভাবে তৈরি করা যায়, তার লক্ষ্য় নিয়েই আনা হয় বিশ্বের প্রথম নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন ও গাড়ির জন্য অডিও সিস্টেম। বোস কোম্পানি ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটি ডলার আয় করে শুধুমাত্র নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন বিক্রি করে। এরপরে পাইলট ও এনএফএল কোচদের জন্যও বিশেষ হেডফোন আনে বোস। ১৯৭৩ ক্যাডিলাক সেভিলে (Cadillac Seville) প্রথম কাস্টম বিল্ট অডিও সিস্টেম আনে বোস। ১৯৮২ সালে মার্সিডিজ ও পোরশের মতো বিখ্যাত গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়িতে বোস অডিও সিস্টেম গাড়িতে যুক্ত করার ঘোষণা দেয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here