কাজের ফাঁকে চা পানের বিরতি চলছে ঠিক সেই সময় হঠাৎই একজন মানুষ নিজ থেকেই ডাক দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, “জানেন ভাই আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, আপনার পরিবারের অথবা বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে অথবা আশেপাশে প্রতিবেশীদের অনেকেই হাতের কাজে খুব দক্ষ। হাত দিয়েই খুব সুন্দর সুন্দর পণ্য তৈরি করতে পারে কিন্তু আমরা এদের মূল্যায়ন করি না তারা ওভাবেই ঘরোয়াভাবে দু-চারটি পণ্য তৈরি করে রেখে দেয় কিন্তু আমরা যদি তাদেরকে সাপোর্ট দিই তাদের পণ্য তৈরিতে যথেষ্ট যোগান দিই তাহলে তারাও কিন্তু হয়ে উঠতে পারে উদ্যোক্তা ” এই কথাগুলো বলতে বলতেই শামীম হোসেন নিজের পরিচয় দিলেন।
তার জন্ম পঞ্চগড় কিন্তু তার পূর্বপুরুষরা নাটোরের বাসিন্দা। তার জন্মের আগেই তার বাবা পেশাগত কারণে পাড়ি জমান পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী এবং সেখানেই তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা।
শামীম একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন এবং ছোটবেলা থেকেই বাবার মুদি দোকানে কাজ করতেন। একটু বড় হলে তিনি নিজেই ইটভাটায় অংশীদারি ব্যবসা শুরু করেন এবং রাইস মিল দেন, বেশ কিছুদিন সে ব্যবসা করেন কিন্তু ব্যবসাটা চালিয়ে যেতে পারলেন না অংশীদারি জটিলতার কারণে। সেখানে খুব বড় একটি লস গুনতে হয় শামীমকে।
টানাপোড়েনে চলছে শামীমের সংসার। সেই বিষয়গুলো নিয়েই তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে কথা হয় তখন তার বন্ধু পরামর্শ দেন হাতের কাজগুলো নিয়ে ভাবা যায় কিনা যেহেতু শামীম এবং তার স্ত্রী হাতের কাজ খুব ভালো জানতেন। হাতে বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ তৈরি করতেন এছাড়াও বিভিন্ন হ্যান্ডিক্রাফট তৈরি করতেন। বায়িং হাউজে কর্মরত সেই বন্ধু বলেন এই পণ্যগুলো যদি একটু যত্ন করে বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করা হয় তাহলে সেই পণ্য গুলো নিয়ে বাইং হাউসে কথা বলবে এবং বিক্রয়ের জন্য চেষ্টা করবে।
শামীম উপায়ন্তর না পেয়ে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ব্যাগ তৈরির কাজ শুরু করলেন ,পরবর্তীতে তার সেই বন্ধুর সহায়তায় এবং নিজের প্রচেষ্টায় তিনি এই পণ্যগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে রূপ দিতে সক্ষম হন যদিও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার কোনো ট্রেনিং ছিল না শুধু নিজের ইচ্ছা এবং হস্ত দক্ষতায় তিনি এই কর্মে সফল হলেন। সম্পূর্ণ জানার জন্য সরোজমিনে তিনি ইন্ডিয়াতে যান যেখানে এ পণ্যগুলো তৈরি হয়।
পরবর্তীতে কাঁচামাল গুলো ইন্ডিয়া এবং চীন থেকে নিয়ে আসেন। শামীম এর উদ্যোগে এখন প্রায় স্থায়ী-অস্থায়ী ভাবে দুশো থেকে আড়াইশো জন আদিবাসী নারীকর্মী আছেন যারা প্রতিদিন দু’শ টাকা পারিশ্রমিক এ কাজ করে তারাও স্বাবলম্বী হয়েছেন।শামীমের বাড়িতেই একটি বড় পরিত্যক্ত জায়গায় তিনি ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছেন যেখানে বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় লেডিস ব্যাগ তৈরি হয়। একজন নারী কর্মী কাপড়ের তৈরি ব্যাগ দিনে একটি তৈরি করতে পারেন এবং সুতো দিয়ে একটি ব্যাগ তৈরি করতে দু’দিন সময় নেন।
তৈরিকৃত কিছু পণ্য বায়িং হাউসের সহায়তায় দেশের বাইরে যায় কিন্তু শামীম বলেন, “আমার কর্মী সংখ্যা প্রায় আড়াইশো জনের মতো স্থায়ী -অস্থায়ী ভাবে কিন্তু তারপরেও আমি বায়িং হাউজ এর অর্ডারগুলো করতে পারি না কর্মী সংকটের কারণে। কারণ তাদের অর্ডার অনেক বেশি যা আমি সীমিত সংখ্যক কর্মী এবং আমার ছোট কারখানায় উৎপাদন করতে পারিনা। তবে আমি চেষ্টায় আছি যদি সম্ভব হয় অবশ্যই আমি তাদের সাথে সেই বাইং হাউজের অর্ডারগুলো সম্পন্ন করব।
বর্তমানে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের স্টল থেকে শামীমের পণ্য বিক্রয় হয় এবং প্রদর্শনী হয় এছাড়াও শামীমের নিজস্ব শোরুম আছে সেখান থেকে পণ্য বিক্রয় হয়। তবে শামীম মূলত অর্ডারি কাজ করে থাকেন। পাইকারি হিসেবে সে পণ্যগুলো সেল দিয়ে থাকেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার পণ্যগুলো যায়। শামীম বলেন তার ব্যাগের ডিজাইন গুলো তিনি চলতে-ফিরতেই সংগ্রহ করে ফেলেন। সজাগ দৃষ্টি রাখেন নতুন কোন ডিজাইন বাজারে এসেছে কিনা। নতুন কি ডিজাইন নিয়ে আসা প্রয়োজন সেই ডিজাইনগুলো তিনি তৈরি করার চেষ্টা করেন। এছাড়াও ইন্টারনেটের সহযোগিতা নেন। শামীমের ইচ্ছা এই ব্যবসাটা তিনি ধরে রাখবেন, ব্যাগেই তার স্বপ্ন বহন করবেন। তার মাধ্যমে এলাকার আদিবাসী নারীদের একটি কর্মসংস্থান হয়েছে এবং তাদের এই কর্মসংস্থান অব্যাহত থাকুক। তিনি সহ এলাকার সকল নিম্নআয়ের মানুষ একটি কর্মের সুযোগ পাক এবং সুন্দর ভাবে জীবন নির্বাহ করুক।
বিপ্লব আহসান