নারী উদ্যোক্তারা তাদের নিজ নিজ দেশের অর্থনীতিতে অবিচ্ছেদ্য অবদান রাখা সত্ত্বেও ব্যবসার জগতে প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হচ্ছেন। বিশ্বের নারী উদ্যোক্তাদের সম্মান জানাতে ও নতুন উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করতে মূলত দিবসটি পালন শুরু হয়।
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে নারী। ইন্টারনেটের বৈপ্লবিক যুগে ফেসবুক বা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের নারীরাও হয়ে ওঠেছেন উদ্যোক্তা।
নারীরা গৃহকর্ম সামলিয়ে বাড়তি পরিশ্রম করে উপার্জন করছেন অর্থ। নিজ দেশীয় বিভিন্ন ধরনের পণ্য (তাঁত পণ্য, শাড়ি, বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, বেতপণ্য, ঘরে বানানো খাবার) ছাড়াও অনলাইনে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন তারা। এমন কিছু নারী উদ্যোক্তার কথা শুনবো আজ।
সামাজিক উদ্যোক্তা তসলিমা ফেরদৌস
সমাজসেবক তসলিমা ফেরদৌসকে অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। স্বামী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছা থেকেই ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। সেসময় তিনি বাচ্চাদের পড়ানো থেকে শুরু করে সূচিশিল্পের প্রশিক্ষক হিসেবেও বেশ কিছুদিন কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি একটি ব্যাংকে চাকরি করেন দীর্ঘদিন।
২০০৫ সালে ‘বেলাশেষে’ নামে একটি প্রবীণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন তসলিমা। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়েও যারা সামাজিক ভাবে অসহায় তাদের জন্য তিনি এই ‘বেলাশেষে’ গড়ে তোলেন। এছাড়াও যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলো না তাদের জন্য ফ্রি সেবা দেয়া হয় সেখানে। এভাবেই শুরু হয় মানবকল্যাণে নিজের মতো করে কাজ করা।
মানবকল্যাণে কাজের জন্য সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি একটি সংগঠন তৈরি করেন। নওগাঁর ইলশাবাড়ির এক খণ্ড জমিতে অসহায় প্রবীণ নারী এবং শিশুদের নিয়ে তসলিমার বাস।
সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা ‘বেলাশেষে’ ২০২০ সালে সরকারে রেজিস্ট্রেশন পায়। এছাড়াও কমিটি গঠনের মাধ্যমে বর্তমানে ‘বেলাশেষে সমাজ কল্যাণ সংস্থা’টি পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে বর্তমানে ১৫ -২০জন বৃদ্ধ মা এবং শিশু রয়েছে।
উদ্যোক্তা তসলিমা ফেরদৌস নিজ উদ্যোগে নওগাঁ শহরে প্রথম মিউজিক্যাল ক্যাফে চালু করেন, যেখানে বর্তমানে শতাধিক খাবারের আইটেম থাকছে এবং সেখানে ৯ জন কর্মীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি যাদের অনেকেই শিক্ষার্থী। মূলত ক্যাফের আয় থেকেই ‘বেলাশেষে’ পরিচালনা করা হয়।
শেষ বয়সে যে বৃদ্ধ মায়েদের নিজ সন্তানের ঘরে আশ্রয় হয় না তাদের একটি নিরাপদ আশ্রয় স্থান এই ‘বেলাশেষে’। এছাড়া রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায় নারী, বিধবা কিংবা ডিভোর্সি নারী যাদের সমাজে মূল্যায়ন করা হয় না তাদের জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তসলিমা ফেরদৌস। তিনি শীতবস্ত্র বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজেও যুক্ত রয়েছেন।
উল্লেখ্য, তসলিমা ফেরদৌস রাঁধুনী কীর্তিমতী হিতৈষী সম্মাননা, বেগম রোকেয়া সম্মাননা, কাবিল খান মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদ থেকে গুণীজন অ্যাওয়ার্ড, মানবতার ফেরিওয়ালা এবং সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘মাদার তেরেসা সাইনিং পার্সোনালিটি অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন।
জাতীয় পুরুস্কারপ্রাপ্ত উদ্যোক্তা ইসরাত জাহান
২০১৭ সাল থেকে পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন ইসরাত জাহান। পড়াশোনা শেষ করে ব্যাংকে চাকরি করতেন তিনি। কিন্তু নিজেকে স্বাবলম্বী হওয়ার সঙ্গে অন্যকেও কাজের সুযোগ করে দেয়ার স্বপ্নটা মাথায় ঘুরতো, তাইতো হুট করে চাকরি ছেড়ে পাটজাত বহুমুখী পণ্যের ব্যবসা শুরু করলেন। গড়ে তুললেন ‘তুলিকা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
‘তুলিকা’ নামে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য ইতালি, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, বেলজিয়াম ও সুইডেন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার সুযোগ হয়েছে। তুলিকাতে পাটের তৈরী ব্যাগ, শপিং ব্যাগ, ওয়াই ব্যাগ, গ্রোসারি ব্যাগ, হ্যান্ডিক্রাফট, হোম ডেকরসহ নান্দনিক শিকেও পাওয়া যায়।
২০২২ সালে বর্ষসেরা মাইক্রো উদ্যোক্তার সম্মাননা পান তিনি।
কারুশিল্পী সাদিয়া শারমিন
চারুকলার ক্রাফট ডিপার্টমেন্টের ট্যাপিস্ট্রি বিভাগ থেকে পড়াশোনা করে এখন তিনি রিসার্চার হিসেবে কাজ করছেন এবং সেই রিসার্চকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ক্রাফটেড প্রোডাক্ট তৈরি করছেন। দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর তিনি ক্রাফটিং এর সাথে জড়িত। বিভিন্ন মিথ, সাইকোলজি এবং গবেষণাধর্মী কাজে যুক্ত রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। এছাড়াও তিনি ১৯ বছর মনসিজ আর্ট একাডেমিতে শিশুশিল্পী নির্দেশক হিসেবে রয়েছেন। সম্পূর্ণ ন্যাচারাল প্রোডাক্ট নিয়ে তিনি কাজ করেন। তার ব্যবহৃত ন্যাচারাল প্রোডাক্টগুলোর মধ্যে রয়েছে সি শেল,শামুক, ঝিনুক, কাঠের পুঁতি, সুতা, পাটের সুতা, শীতলপাটির বুনন, পোস্টেজ স্টেম্প বা ডাকটিকিট।
গহনা সেক্টরে সম্পূর্ণ অর্গানিক পণ্যকে বিভিন্ন ডিজাইনে উপস্থাপন করছেন সাদিয়া। এরই মধ্যে পালকের তৈরি গহনা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রঙ-বেরঙের পালক দিয়ে তৈরি এসব গহনা সম্পর্কে জানতে ক্রেতাদের আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও সি শেল এর তৈরি নেকলেস, পায়েল, কানের দুল, হেয়ার ব্যান্ড, রিং স্টুডেন্টরা বেশ পছন্দ করছেন।
মূলত দেশের বাইরে তার প্রোডাক্টের চাহিদা বেশি। জাপান ও লন্ডন ছাড়াও ইন্ডিয়ার আটটি স্টেটে গিয়েছে তার প্রোডাক্ট। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন কর্তৃক দক্ষ কারুশিল্পী (কারুগৌরব) অর্জন করেন সাদিয়া শারমিন।
সফল নারী ফ্রিল্যান্সার ঝুমা বেগম
“শিখবে সবাই” থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইন কোর্স করে বর্তমানে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে ক্রিয়েটিভ অ্যাড ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন সিলেটের ঝুমা বেগম। তিনি চাকরির পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটেপ্লেসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজও করেন।
ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামী স্ট্রোক করে মারা যান। স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা ঝুমা। ভাইয়ের পরামর্শে গ্রাফিক ডিজাইন, মোশন গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ শেখেন। সন্তান একই সঙ্গে পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন করতে শুরু করে ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে।
বর্তমানে তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে ক্রিয়েটিভ অ্যাড ডিজাইনার হিসেবে চাকরি করছেন। পাশাপাশি লোকাল মার্কেটপ্লেসেও ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন।
ইন্টারন্যাশনাল এবং লোকাল মার্কেট মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক এইচটিএমএল-ফাইভ (HTML-5) ব্যানার অ্যানিমেশন এবং অস্ট্রেলিয়ান ক্লায়েন্টের ১৫টির অধিক (GIF) অ্যানিমেশনের কাজ করেছেন ঝুমা বেগম। বর্তমানে তিনজনের একটি দল করে বিভিন্ন লোকাল এবং ইন্টারন্যাশনাল কাজ করে যাচ্ছেন।
এখন পর্যন্ত ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিভিন্ন প্রজেক্ট করে তার মোট আট হাজার ডলারেরও (আট লাখ ২৫ হাজার টাকা) বেশি আয় হয়েছে।
সম্প্রতি তিনি ইউটিউবে তিনি একটি চ্যানেল খুলেছেন, যেখানে মোশন গ্রাফিক্সের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষণীয় অ্যানিমেশন ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চ্যানেলটি মনিটাইজেশনের অধীনে চলে আসায় সেখান থেকেও আয়ের একটি নতুন উৎস পেয়েছেন তিনি।
নবীন উদ্যোক্তা মারিয়া মেহেজাবিন কিপতিয়া
লালমাটিয়া মহিলা কলেজের বোটানি ডিপার্টমেন্টের ২য় বর্ষের ছাত্রী মারিয়া। পড়াশোনার পাশাপাশি হ্যান্ডমেড জুয়েলারি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। জমানো ৬ হাজার টাকা নিয়ে তিনি তার উদ্যোগ শুরু করেন। বিভিন্ন কাস্টমাইজড ডিজাইনের নানাবিধ জুয়েলারি নিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছেন মারিয়া যা ইতিমধ্যে দেশের প্রায় ৫০ টি জেলায় পৌঁছে গেছে। মাসে ২৫ – ৩০ হাজার টাকা আয় হয় তার এই হ্যান্ডমেড জুয়েলারি তৈরির মাধ্যমে।
বাংলাদেশের সকল প্রান্তে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধরা দিচ্ছে এই সকল নারী উদ্যোক্তা। নবীন উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর পালিত হয় বিশ্ব নারী উদ্যোক্তা দিবস।
সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা