কবির ভাষায় “বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। নারীর প্রতি অবিচার এবং সমাজের প্রত্যেকটি নারী পাবে তার যথার্থ সম্মান, অর্জিত হবে নারী অধিকার এই ব্রত নিয়ে প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবস।
‘নারী মানেই অবলা’ এই ভ্রান্ত চিন্তা পাল্টে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। নারীর জন্ম হয়েছে কেবল রান্না, খেদমত ও বাচ্চা পালনের জন্য নয়, এগুলোর পাশাপাশি আরও অনেক সৃজনশীল কাজের জন্যও তাদের জন্ম হয়েছে।
এখন নারীদের চলার পথ মসৃণ করতে, তারা নিজেদের পরিচয় গড়তে সংসারের পাশাপাশি নিজের সৃজনশীল জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ করতে সফল তার উদাহরণও আমাদের সামনে সমুজ্জ্বল। চাকরির কিংবা গৃহিণী থেকে গড়ে উঠছে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তা। তারা তাদের প্রতিভা পৌঁছে দিয়েছে বিশ্ব দরবারে এবং এটা অব্যাহত থাকবে বিশ্লেষকদের জরিপে তেমনটাই দেখা যায়।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট অনুসারে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে পৌঁছাবে। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশ হবে বাংলাদেশ।বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করা হয়েছে এই রিপোর্টে। এক্ষেত্রে দেশের পরিবারে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ভূমিকার প্রশংসা করেছেন অর্থনীতিবিদগণ। ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে এদেশের নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।
নারীদের অর্থনীতিতে আরও ব্যাপকহারে সম্পৃক্তকরণের জন্য সরকার নানামুখী কর্মসূচিও গ্রহণ করেছেন। সরকার বেকার যুব সম্প্রদায়ের আত্মকর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মমুখী শিক্ষা ও তরুণদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। বলা হয়ে থাকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা হলো অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তারা দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনে নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তাই উদ্ভাবক ও জীবনের শিক্ষা থেকে সকল প্রতিকূলতা দূরীকরণে সংকল্পবদ্ধ। তাদের সাফল্যের পরিধি গৃহস্থালী সঞ্চয় বৃদ্ধি, শিশু স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিনিয়োগ থেকে শুরু করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপির উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
উল্লেখ্য করোনাকালের এই সংকটময় সময়ে সবচেয়ে বেশি নারী উদ্যোক্তা গড়ে ওঠেছে। তারা তাদের জন্য যখনই একটু সময় পেয়েছে, তখনই তাদের প্রতিভাগুলোকে খুঁজে বের করে তা বাস্তবসম্মত কাজে লাগিয়ে দেশ ও দশের উপকারে আসতে সক্ষম হয়েছে।
২০২০ সাল নারীকে দিয়েছে ভিন্ন পরিচয় গড়ার সুযোগ। কেউ প্রয়োজনে আবার কেউ শখ করেই বেছে নিয়েছে উদ্যোক্তা পেশাটি। তবে অধিকাংশ নারী তার ভালো লাগার কাজগুলো ভালোবেসে নিজেদের পরিচয় তৈরিতে মেতে উঠেছে। নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশি ঐতিহ্যের প্রকাশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডুবতে বসা দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহককে নারীরা দিয়েছে ভিন্ন পরিচয়। এই সব উদ্যোক্তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাও করে দেয়া হচ্ছে যেন কেউ ঝরে না যায়। দেশ গড়ে উঠবে নতুনরূপে, নতুন পরিচয়ে। তাই এই নারী দিবসে ভিন্ন আঙ্গিকে নারীর চলার পথ মসৃণ করতে সকলকেই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
ভেনচার ক্যাপিটাল রিসার্চ ডেটাবেজ পিচবুক থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ একটি পরিসংখ্যান(২০১৭) বলে, পৃথিবীর মাত্র দুই শতাংশ নারীর কাছে তাদের ব্যবসা পরিচালনার মূলধনটি থাকে। এমনকি এ গবেষনা থেকে আরো জানা গেছে বিনিয়োগকারীরা একজন পুরুষ উদ্যোক্তার উপর তাদের সফলতার সম্ভাব্যতার প্রতি দৃষ্টি রেখে যখন বিনিয়োগ করে ঠিক তখনই একজন নারীর ক্ষেত্রে তার চিত্রটি যেন মুদ্রার এপিঠের ঠিক উল্টো। শতকরা হিসেবে গুটিকয়েক বিনিয়োগকারী ব্যতীত সকলেই নারী উদ্যোক্তার উপর বিনিয়োগের সময় সর্বপ্রথম যাচাই করেন স-প্রমান ট্র্যাক রিপোর্ট। যা একজন নবীন নারী উদ্যোক্তার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব।
যেখানে পুরো পৃথিবী দিচ্ছে প্রতি ১০০জনে ২জন উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পরিসংখ্যান, সেখানে বাংলাদেশের চিত্রটি আশার আলো দেখায়। বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তার শতকরা ৩১.৬১ ভাগ নারী। নারী উদ্যোক্তা তৈরীর ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নারী উদ্যোক্তার এই বিপুল সম্ভাবনা কেবল শহরকেন্দ্রিক নয়। বরং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসএমই ক্লাস্টারগুলো নিয়ে একটু পড়াশুনা করলেই দেখা মিলবে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তার। যারা সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
এছাড়াও এসএমই এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্র যেমন চামড়া শিল্পের দিকে তাকালে দেখা যায় নারীদের জয়জয়কার। কেবল চামড়াজাত শিল্পের ক্ষেত্রেই নয়! জুট, হ্যান্ডিক্রাফট, প্রিন্টিং, ব্লক-বাটিকে দেশীয় পোশাক, নকশীকাঁথা, তাঁতশিল্প, ট্রাভেল এজেন্সী, তথ্য-প্রযুক্তি, শিক্ষা, চিকিৎসা কোথায় নেই নারী উদ্যোক্তারা! দেশের উন্নয়নের সকল এসএমই খাতে তারা হয়ে উঠেছেন দুর্জয় কাণ্ডারী।
নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়া এই নারী উদ্যোক্তারা নারী ক্ষমতায়নের দূত হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একটি বলিষ্ঠ কর্মীবাহিনীকে, গড়ে তুলছেন দক্ষ জনশক্তি। আজ নারী উদ্যোক্তা দিবসে উদ্যোক্তা বার্তা অভিবাদন জানায় সকল নারী উদ্যোক্তাদের, যারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে দেশ ও দেশের বাইরে বাংলাদেশকে পরিচিত করছেন তাদের কর্মে ও সাফল্যে। দেশ উন্নয়নের কোমল হাতের কঠোর যোদ্ধারা, শুভেচ্ছা আপনাদের প্রতি।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা