বাবার চিকিৎসা করাতে না পারা জুঁই স্বাচ্ছন্দ্য এনেছেন ৪০০ পরিবারে

0
উদ্যোক্তা রুমানা আক্তার জুঁই

চিকিৎসার জন্য বাবাকে নিয়ে দেশের বাইরে গিয়েছিলেন মেয়ে। চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারায় দেশে আত্মীয়-স্বজনকে জানান। তেমন কেউ এগিয়ে না আসায় অর্থসংকটে চিকিৎসা শেষ না করেই বাবাকে নিয়ে দেশে ফিরতে হয়। দুদিন পরই বাবা মৃত্যুবরণ করেন। মা এবং ছোট ভাইকে নিয়ে ভাবনা শুরু হয় রুমানা আক্তার জুঁই এর। মামা বাড়ি পাশে দাঁড়ালেও সব চাহিদা কি তাদের মুখ ফুটে বলা যায়? বাবা থাকতে যে সন্তানদের শত কষ্টেও স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতেন, তারা অন্য পরিবারে গেলে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে চাহিদার কথা বলতে পারেন? সে কারণেই নিজে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্যে এবং পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে কাজিনের অনুপ্রেরণায় উদ্যোক্তা জীবনে রাজশাহীর দুর্গাপুরের জুঁই।

২০১৭ সালে পাঁচ হাজার টাকার তিনটি টুপিস তৈরির কাপড়, কিছু সেলাই সামগ্রী নিয়ে জুঁই এর পথচলা শুরু। সে সময় স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত জুঁই এর কোন ফেসবুক পেজ বা নিজস্ব আইডি কিছুই ছিল না। মেসে থাকার সুবাদে এর মুখ থেকে ওর মুখ থেকে বিভিন্ন ভাবেজুঁই এর হাতে তৈরি ড্রেসগুলোর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মেসমেট, তাদের পরিচিতরা, কলেজ ফ্রেন্ড, কলেজের শিক্ষিকা সকলেই আস্তে-আস্তে জুঁই এর ক্রেতা হতে থাকেন। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন জুঁই এর ছোট ভাই এবং তার সহধর্মিণী। ভাই এবং তার বন্ধুবান্ধবেরা জু্ঁই এর কাজ চারদিকে ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। জুঁই এর মা-ও সবসময় মেয়েকে সাহস যুগিয়েছেন। প্রথম দিকে জুঁই এর পণ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সোর্স ছিলেন মেডিকেল শিক্ষার্থীরা।

২০১৮ সালে যুব উন্নয়ন থেকে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর প্রশিক্ষণ নেন এই উদ্যোক্তা। প্রশিক্ষণ শেষে ৫০ হাজার টাকা লোন নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কাজ শুরু করেন। এভাবে ওয়ান পিস, টুপিস, থ্রিপিসসহ পণ্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৯ এ সামাজিক পাতায় ‘সপ্তরং বুটিকস’ নামে পেজ চালু করেন জুঁই। সেখান থেকেও বেশ ভালো সাড়া মেলে। ধীরে-ধীরে পরিচিতি যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি অর্ডার সংখ্যাও। আজ জুঁই এর সাথে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন ৪০০ জন সহযোদ্ধা। দশজন লিডার সবসময় সেসকল সহযোদ্ধাকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। আর সকলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন উদ্যমী এই তরুণী। একসময় অর্থ সংকটে বাবার চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারলেও আজ ৪০০ পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার কাণ্ডারী জুঁই।

কাজ শেখার বিষয়ে রুমানা আক্তার জুঁই বলেন, “শুরুর দিকে জামালপুর, ঢাকা, রংপুর, যশোর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি আমি। সেখানকার বুটিকগুলোর কাজ দেখেছি, চেষ্টা করেছি সেগুলো আয়ত্ত করার। পরবর্তীতে যুব উন্নয়ন এবং এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এভাবেই ধীরে ধীরে শেখা। বর্তমানে আমার পণ্যগুলোর ডিজাইনও আমি করে থাকি। ফ্যাশন ডিজাইন কোর্স করায় এই বিষয়গুলোতে আমার খুব একটা ঝক্কি পোহাতে হয় না। সপ্তরং বুটিকস এর হাতের কাজের পোশাকে নিজস্ব ডিজাইন হওয়ায় অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে এর নকশা ভিন্ন, তাই চাহিদাও থাকে ব্যাপক।”

বর্তমানে রাজশাহী ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, খুলনাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় পাইকারিতে পণ্য দেন জুঁই। এছাড়াও সারাদেশে খুচরাতে পণ্য সরবরাহ করেন। তবে তার ৮০ শতাংশ পণ্যই ক্রয় করেন অন্য ব্যবসায়ীরা, যাদের নিজস্ব শো-রুম আছে বা অনলাইনে বিজনেস করছেন তারাই মূলত জুঁই এর ক্রেতা। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে তৈরি হাতের কাজের ওয়ান পিস, টু-পিস, থ্রি-পিস, কুশিকাটা নেক, সিঙ্গেল ওড়না, কুশন ছাড়াও সপ্তরং বুটিকসে বিছানার চাদর,সুপারি খোল দিয়ে তৈরি থালা,বাটি, মৌসুমে আম এবং গুড় ইত্যাদি রয়েছে।

উদ্যোক্তা জীবনে প্রবেশের পর থেকেই বিভিন্ন মেলায় অংশ নিয়েছেন জুঁই। ২০২১ সালে নারী উদ্যোক্তার খোঁজে সংগঠন থেকে মেলার আয়োজনও করেছিলেন তিনি। সম্প্রতি শেষ হওয়া রাজশাহী কালেক্টরের মাঠে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি মেলাতে পঞ্চম স্থান এবং রাজধানীতে একটি মেলায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন জুঁই।

আগামীতে আরও অনেক পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চান, নিজেকে নিয়োজিত করতে চান সেবামূলক কাজে। এই উদ্যোক্তার জন্ম থেকে বেড়ে উঠা রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার শিবপুর গ্রামে। তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্য স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে রাজশাহী নগরীতে বসবাস করছেন জুঁই।

তামান্না ইমাম,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here