বাতিঘর সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের সাথে তামান্না সেতু

আধখান গ্রাম, আধখান শহরের একটা বাড়ি। বাড়ি ভরা মানুষ, সারাদিন হৈচৈ, হাসি আনন্দ, গল্পে বেড়ে উঠা এক শিশু। আশপাশের মহল্লাবাসীরা সকলে মিলেই যেন একটা ঘর। প্রতিবেশীরা সকলেই যেন সেই ঘরের মানুষ। দুরন্ত শৈশবে সবাই এখানে আপনজন। ছোট্ট শিশুটির কাছে এ যেন এক আনন্দ ভূবন। পারিবারিক সম্পর্কের সংকটে হঠাৎ করেই শিশুটির জীবনে এলো সেই দুরন্তপনার ছেদ। বাবা-মায়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ হলো। ঘরভরা মানুষের নানীবাড়ির সেই আনন্দ ভূবন ছেড়ে একসময় চলে আসতে হলো ঢাকায়। মা সারাদিন বাইরে কাজে থাকতেন। বাসায় ছোট্ট শিশুটি একা। সারাদিন ছুটে বেড়ানো শিশুটির জগৎ হলো একটা ছোট ঘর। যে ঘর ভরা মানুষ নেই, গল্পে গল্পে আনন্দের সুর তোলার কেউ নেই, মাঝদুপুরে পুকুরে ঝাপিয়ে পরা বন্ধুদের সঙ্গ নেই।

উদ্যোক্তা- তামান্না সেতু

জীবনকে উপভোগ করতে যে শিশুটির জীবনে কোনো রসদের অভাব ছিল না সেই শিশুটি হয়ে গেল একা। সেই শিশুটি বেড়ে উঠলো, কৈশোর এলো। মা দ্বিতীয়বার বিয়ের পিড়িতে বসলেন। এই ঘরে বনিবনা হলো না। ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে ঝগড়ার সূত্রপাতে মায়ের ঘর ছেড়ে মেয়েটি একসময় বাবার কাছে ফেরত যান। বাবার ঘরে সৎমায়ের সাথেও নিজেকে মেলাতে পারতেন না সেই মেয়েটি। সময়ের প্রয়োজনে দশম শ্রেনীতে পড়া কিশোরী মেয়েটির বিয়ে হলো।

কিশোরী তামান্না সেতু

স্বামীর সাথে বিশাল বয়সের ব্যবধানে ঘর বাধা কিশোরীর সংসার হলো ঠিকই, স্বামীর সাথে কেন যেন মনের মিল হলো না। কিশোরীর বয়স যখন ১৬, কোলজুড়ে আসলো প্রথম সন্তান। কিশোরী মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু। সেই শিশুকে কোলে নিয়েই পড়াশুনা। বয়স যখন ১৯ তখন কোলে এলো দ্বিতীয় সন্তান। একসময় স্বামীর সাথে মনোমালিন্য চরমে পৌছালো। দুটো কোলের সন্তান নিয়ে মাত্র ২৪ টাকা হাতে ঘর ছাড়লেন কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা রাখা তামান্না সেতু।

বাতিঘরের অধ্যক্ষ মেহেদী হাসান শোয়েব ও পরিচালক তামান্না সেতু

জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় শুরু হলো এবার। ঘর ছাড়া তামান্না কোলের সন্তান দুটো নিয়ে বাবার কাছে গেলে বাবা বললেন, “তুমি বাচ্চা দুইটারে ফিরায়ে দিয়ে আসো। তোমাকে আমরা দেখেশুনে আবার বিয়ে দেবো। তুমি সুখী হবা।” বাবার কথায় ভীষন কষ্ট পেলেন মনে মনে। একসময় ফিরে গেলেন সেই শৈশবের নানীবাড়িতে। নানীবাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল বেশ। কিন্তু সেখানেও থাকা হলো না বেশিদিন। মায়ের কাছেও থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। সেই আশ্রয়ও ছেড়ে দিলেন। সেই দুঃসময়ের কথা বলতে গিয়ে হাসতে বললেন তামান্না, “ঘরছাড়া মেয়ে সকলের কাছেই যেন সতীন হয়। টিকে থাকা তাই মুশকিল ছিল।”

সবচেয়ে নির্ভরতার বন্ধু বড় ছেলে আরাফ

দুই সন্তান আর নিজের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনে সব ছেড়েছুড়ে ঘরছাড়া মেয়ে পথেঘাটে খুঁজতে থাকেন একটা চাকুরী। প্রবেশ করলেন চাকুরী জীবনে। চাকুরীর শুরু হয় ওয়েলফেয়ার অফিসার হিসেবে একটি গার্মেন্টেসে। ছোটবেলা থেকে আর্থিক স্বচ্ছলতায় বড় হওয়া তামান্নার অল্প বেতনের টাকায় সংসার চালানো ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রায় অনেকটা দিন ভ্যানের উপর থেকে কেনা পোশাকে বাচ্চাদের ঈদ করিয়েছেন তামান্না। কষ্টের দিনগুলো একটু একটু করে ঘুচতে লাগলো। একে একে বিভিন্ন টেক্সটাইল জোন, কুয়েত এয়ারলাইন্সে চাকুরী করেন দীর্ঘদিন। কোলের সন্তান দুটো বড় হলো। তবুও বাবা ছাড়া উৎসব-পার্বনগুলোতে এক অপূর্নতা ভর করতো তিন সদস্যের পরিবারে। প্রায় অর্ধযুগেরও বেশী সময় সন্তান দুটোকে সাথে নিয়ে একলা যুদ্ধ করে গেছেন তামান্না। বড় ছেলে আরাফ আর ছোট ছেলে ধ্রুব ছিল বন্ধুর মতো। সেই বন্ধুরা মিলেই বিয়ে দিল মা’কে। সাত বছর সিঙ্গেল মাদার তামান্নার জীবন সঙ্গী হলেন মেহেদী হাসান শোয়েব। ঘর ছাড়া সুখী মেয়ের জীবন পেলো আরেক নতুন মাত্রা। সবচেয়ে কাছের দুই বন্ধু সন্তান আরাফ-ধ্রুবর সাথে স্বামী শোয়েব হলেন শক্ত করে হাত ধরবার বাঁধন। জীবনসঙ্গী শোয়েব আর তামান্নার সুখের সংসার। শত বাধা-বিপত্তির মাঝেও আজীবন সুখী বলতে স্বচ্ছন্দ্য তামান্না বলেন, “শোয়েব আমার সুখের অনেক পালকের এক পালক। সুখকে জয় করা যায় আরো একবার বিশ্বাস করি শোয়েবকে পেয়ে।”

বাতিঘর সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের সাথে তামান্না সেতু

বিবাহ জীবনের আগের শোয়েব আর বিবাহিত শোয়েব বরাবরই একটু স্বাধীনচেতা। কোনো চাকুরীতেই সেই স্বাধীনতার সুবিধা না পেয়ে বারবার চাকুরী ছাড়েন। একসময় তামান্না ও শোয়েবের আলোচনায় তারা সিদ্ধান্ত নেন একটি স্কুল দেবেন। স্কুলের নাম “বাতিঘর সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়।

চলবে…

 

সাদিয়া সূচনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here