ফ্যাশন জগতের অন্যতম আইকন ঋতু কুমার

0

১৯৪৪ সালের ১১ নভেম্বর ভারতের অমৃতসরে জন্মগ্রহণ করেন ঋতু কুমার। দিল্লীতে বেড়ে ওঠা ঋতু ১৯৬৪ সালে সেখানকার ‘লেডি আরউইন কলেজ’ থেকে স্নাতক পাস করেন। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।

তিনি ‘মিউসিওলোজি’ বা ‘প্রদর্শনশালা সংক্রান্ত বিদ্যা’ এবং ‘আর্ট হিস্ট্রি’ বা ‘শিল্পের ইতিহাস’ বিষয়ে ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কের ‘ব্রায়ারক্লিফ কলেজ’ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। আর এই দুই বিষয়েরই প্রতিফলন তার কর্মজীবনে প্রত্যক্ষ করা যায়।

ফ্যাশন ব্যবসায়ে ঋতুর পদার্পণ ঘটেছিল খুবই অনাড়ম্বরভাবে। যিনি ভারতীয় ফ্যাশন জগতের পথিকৃতদের একজন। তাকেও একেবারে শুরু থেকেই শুরু করতে হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোট গ্রামে বেকার হ্যান্ড ব্লক প্রিন্টারদের একটি ছোট বসতি খুঁজে পান, তাদেরকে দেখেই ঋতুর মনে একটি উদ্যোগ গড়ে তোলার চিন্তা জাগে। মূলধন ছিলো মাত্র ৫০হাজার টাকা, ১৯৬০ সালে কোলকাতার সেই ছোট্ট গ্রামে তিনি মাত্র দু’টি টেবিল ও কয়েকজন ব্লক প্রিন্টারকে নিয়ে তার এই ব্যবসায়ের যাত্রা শুরু করেন।

তিনি এই দক্ষ হ্যান্ড ব্লক প্রিন্টারদের থেকে সুন্দরভাবে শাড়ি প্রিন্ট তৈরি করান, যা তিনি ক্রমাগত প্রদর্শনী এবং ভাড়া পরিদর্শন করে জনপ্রিয় করেছেন। 70 এর দশকের গোড়ার দিকে, তিনি রানীহাটিসের সূচিকর্ম আবিষ্কার করেছিলেন, যা এখন জারদৌসি নামে পরিচিত।

মুঘল আমলের প্রসিদ্ধ ‘জারদৌসি’ শিল্পের সংরক্ষণেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার ব্র্যান্ডের মূল পণ্য- কনের পোশাক ও রাতের অনুষ্ঠানের জমকালো পোশাক- তৈরিতে মূলত: দামি ফ্যাব্রিকের ওপরে স্বর্ণের তৈরি সুতোর এমব্রয়ডারি আর স্বকীয় প্যাটার্নের জারদৌসি কাজেরই ব্যবহার হয়ে থাকে। তিনি পোশাক তৈরিতে মূলত সিল্ক, লেদার ও তুলা বেশি করে ব্যবহার করেন।

১৯৯৯ সালে ভারতের বুনন ও নকশা শিল্পের ইতিহাস নিয়ে রিতু ‘কস্টিউমস্ অ্যান্ড টেক্সটাইলস্ অভ রয়্যাল ইণ্ডিয়া’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।

২০০২ সালে পুত্র অমরিশ কুমারের সাথে অংশীদার ভিত্তিতে তিনি, কনের পোশাক তৈরিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই ব্র্যান্ডটির দ্বিতীয় অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘ঋতু কুমার, লেবেল গড়ে তোলেন। রিতুর প্রতিষ্ঠানের মূল পোশাক জারদৌসি কাজে তৈরি, যা অত্যন্ত ভারি ও জমকালো। আর লেবেলের পোশাক তুলনামূলকভাবে কম ভারি ও কম জমকালো এবং ভারতের বাইরে, পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয়।

২০১৯ সালে তিনি ‘ঋতু কুমার হোম’ নামে গৃহস্থালীর সাজসজ্জায় ব্যবহৃত কাপড়ের তৈরী পণ্যের একটি নতুন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন । লক্ষ্ণৌয়ের সূক্ষ্ম জালি কারুকাজের ‘আওয়াধ’, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার হ্যান্ডপেইন্ট ও ব্লকপ্রিন্টের ‘কলমকারি’, রাজস্থানি বগ্রু ও সঙ্গানের প্রিন্টের ‘বঙ্কু’, কাশ্মীরের প্রসিদ্ধ ‘জামেভার’ ও কাঁসাসহ মোট ১০টি ভিন্ন ভিন্ন হস্তশিল্পের নকশায় তৈরী মোট ১০টি কালেকশন নিয়ে তিনি এই ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু করেন। এই ব্র্যান্ডের পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টেবিলের কভার, বিছানার চাদর, পর্দা ও গৃহস্থালির সাজসজ্জার অন্যান্য পণ্য।

ডিজিটাল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে তিনি ২০২০ সালে তার একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করেছেন।

আজ অর্ধ শতকেরও বেশি সময় পরে ভারত ও ভারতের বাইরে ‘ঋতু কুমার’ ব্র্যান্ডের ৯০টিরও বেশি শো-রুম রয়েছে। তার এই ব্র্যান্ডের বদৌলতেই ভারতরে হাজারো হস্তশিল্পীর রোজগারের ব্যবস্থা হচ্ছে এবং লোকজ হস্তশিল্প সংরক্ষণও হচ্ছে।

ভারতের ফ্যাশন জগৎ ও হস্তশিল্পের সংরক্ষণে অবদান রাখার জন্য ঋতু কুমার ২০১৩ সালে ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’ অর্জন করেন। ২০১২ সালে ল‘রিয়েল প্যারিস তাকে ‘ফেমিনা উইমেন্স অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। ফ্যাশন জগতে অবদানের জন্য তিনি ‘ইন্দিরা গান্ধী প্রিয়দর্শিনী’ পুরস্কারেও ভূষিত হন।

২০০০ সালে ‘কিংফিশার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’ তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করে। তার কাজের জন্য ফরাসি সরকার তাকে ‘শেভালিয়ে দে আর্ট এহ দে লেতার্স’ (নাইট অভ দ্য অর্ডার অভ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স) নামক সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৯৮ সালে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দু’টি পুরস্কার লাভ করেন: পিএইচডি চেম্বার অভ কমার্স কর্তৃক প্রদত্ত ‘আউস্ট্যান্ডিং উইম্যান অন্ট্রাপ্রেনর অ্যাওয়ার্ড’ ও ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অভ ফ্যাশন কর্তৃক প্রদত্ত ‘আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’।

প্রচলিত ফ্যাশন শো গুলিতে তিনি তাঁর ডিজাইনের পোশাক গুলি প্রদর্শিত করান। যেখানে তাঁর ডিজাইনের পোশাক বহু অভিনেত্রী র‌্যাম্পে হাঁটেন। প্রিন্সেস ডায়ানা, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, মাধুরী দীক্ষিত, দিব্যা খোসলা (Divya Khosla) থেকে শুরু করে তাপসী পান্নু(Tapshi Pannu), বাণী কাপুর(Bani Kapoor), অদিতি রাও হায়দারি(Aditi Rao Haydari), নিমরত কৌর(Nimrat Kaur), দিশা পাটানি(Disha Pathani) এবং কৃতি স্যাননের(Kriti Sanon) মতো সুন্দরী অভিনেত্রীরা তাঁর ডিজাইন পোশাক পড়েছেন।

ভারতীয় ফ্যাশন জগতে প্রথমবারের মতো আধুনিক পাশ্চাত্য বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সমসাময়িক পোশাকের প্রবর্তনকারী, ৭৫ বছর বয়সী ফ্যাশন ডিজাইনার ‍রিতু কুমারের যাত্রা খুব সাদামাটাভাবে শুরু হলেও তার পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প ও স্বকীয় সৃজনশীলতার কারণে আজ তিনি ভারতীয় ফ্যাশন জগতের অন্যতম কর্ণধার হিসেবে সমাদৃত।

আজ, ঋতু কুমারের ডিজাইন করা একটি লেহেঙ্গা অনেক ভারতীয় বধূর স্বপ্ন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here