উদ্যোক্তা- কাজী আজিজুল হক

উনবিংশ শতকের শেষের দিকের কথা। বেঙ্গল পুলিশের দফতরে কাজে ডুবে আছেন দুই বাঙালি সাব ইনস্পেক্টর কাজী আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসু। দু’জনেই মেতে আছেন অপরাধ বিজ্ঞানের একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে। চারিদিকে ছড়ানো আঙুলের ছাপের নমুনা। সেসব দিয়েই একটা নতুন সিস্টেম শুরু করার ভাবনায় তারা। যত এগোচ্ছেন, ততই উত্তেজনা চেপে বসেছে ভেতরে। হঠাৎই এল সেই মুহূর্ত- ‘ইউরেকা!’ তৈরি হল অপরাধী শনাক্তকরণের নতুন পদ্ধতি। গোটা বিশ্বের সামনে এল ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট ভেরিফিকেশন’।

প্রতিটি মানুষের আঙ্গুলের অগ্রভাগে সুবিন্যস্ত কতগুলো রেখা রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি ব্যক্তির এ সকল রেখা অদ্বিতীয়ভাবে সাজিয়েছেন। কোন একজনের আঙ্গুলের অগ্রভাগের রেখাবিন্যাস অপর কারো রেখাবিন্যাসের সঙ্গে কখনো মিলে যায় না। আঙ্গুলের অগ্রভাগের এ সকল রেখাবিন্যাসের প্রতিচ্ছবিই হচ্ছে ফিংগার প্রিন্ট। কোন ব্যক্তিকে অদ্বিতীয়ভাবে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় ফিংগার প্রিন্ট।

ফিঙ্গার প্রিন্ট তথা আঙুলের ছাপের আবিষ্কারক একজন বাঙালি, কিন্তু সেই আবিষ্কার চুরি করে নেয় তারই ঊর্ধ্বতন ইংরেজ কর্মকর্তা। সে চুরির ঘটনা এখন আর গোপন নেই। ১০০ বছর পর ইতিহাস মুখ খুলেছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের আবিষ্কারকের আসল পরিচয় হচ্ছে তিনি খুলনার একজন বাঙালি, নাম কাজি আজিজুল হক। এটা সে বিস্মৃত বাঙালিরই বিরল আখ্যান।

অপরাধী শনাক্ত করার কাজে আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে ঊনবিংশ শতকের শেষের দিক থেকে শুরু হওয়া এবং বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত চলতে থাকা গবেষণার ফিরিস্তি নিয়ে আলোকপাত করি। তাহলেই আমরা পেয়ে যাব সেই বিস্মৃত বাঙালিকে যার নাম আজিজুল হক এবং দেখব তার গবেষণালব্ধ কাজের মূল্য কত গভীর ও বিস্তৃত!

শুধু তাই নয়, তার উদ্ভাবিত এ পদ্ধতি বহু বাধা-বিপত্তি উড়িয়ে দিয়ে আজ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। তাকে বাদ দিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট তথা আঙুলের ছাপের ইতিহাস হতে পারে না।

তার এ বিরল কৃতিত্ব অন্য অনেক কিছুর মতো চুরি করে নেয় একজন ব্রিটিশ শীর্ষচূড় কর্মকর্তা, তবে ইতিহাসের সঠিক বিচার তার প্রাপ্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এবার শোনা যাক সেই বিস্মৃত মুসলিম বাঙালির বিরল আখ্যান।

তার পারিবারিক নাম কাজি সৈয়দ আজিজুল হক। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে তখনকার খুলনা জেলার ফুলতলার পয়োগ্রাম কসবায়। বয়সে তিনি যখন একেবারে তরুণ, তখন তার মা-বাবা দু’জনই নৌ-দুর্ঘটনায় ইহজগৎ ত্যাগ করেন।

একপর্যায়ে তিনি ১২ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। বহু পথ পাড়ি দিয়ে পা রাখেন কলকাতা মহানগরীতে। ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত আজিজুল হক নগরীর কোন এক বাড়ির সামনে এসে ঘুমিয়ে পড়েন।

সে ঘুমন্ত কিশোরটিকে বাড়ির অভিভাবকের ভালো লেগে যায়। ফলে তিনি তার লালন-পালন, লেখাপড়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। গণিতে আজিজুল হকের মাথা খুবই ভালো ছিলো।

হাইপেরিয়ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত ফিঙ্গার প্রিন্টস বইয়ের লেখক ও গবেষক কলিন বিভানের মতে- আজিজুল হক যখন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, তখন তাকে ফিঙ্গার প্রিন্ট তথা আঙুলের ছাপ সংক্রান্ত একটি প্রকল্পে কাজ করার জন্য মনোনীত করা হয়। স্বয়ং কলেজের অধ্যক্ষই তাকে মনোনীত করেন। ব্রিটিশরাজের অধীনস্থ বাংলার পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল তখন স্যার অ্যাডওয়ার্ড হেনরি। তার নেতৃত্বেই এই প্রকল্পের কাজ চলছিলো।

গণিত ও পরিসংখ্যানে ভালো, এমন কাউকে তিনি খুঁজছিলেন এ কাজে। এ ক্ষেত্রের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে কলেজের অধ্যক্ষ আজিজুল হককেই এ কাজের জন্য বেছে নেন।

অধ্যক্ষের সুপারিশে পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে ১৮৯২ সালে চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে হেনরি তাঁকে তাঁর প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ করে দেন।

অখণ্ড বাংলায় তখন অ্যানথ্রোপমেট্রি (মানবদেহের আকৃতি) পদ্ধতিতে অপরাধী শনাক্ত করার কাজ চলত। অ্যাডওয়ার্ড হেনরি এই পদ্ধতিতে বেশ ত্রুটি খুঁজে পেলেন। দেখলেন, একজন লোকের দেহের মাপ বিভিন্ন হাতে এক ধরনের থাকে না।

কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কাজ শুরু হয়ে গেলো। ১৮৯৩ সালের ৩ জানুয়ারি তাই তিনি এক পরওয়ানা বলে অপরাধের সঙ্গে জড়িত লোকজনের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের টিপ নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এর তিন বছর পর তিনি ধরা পড়া প্রত্যেক অপরাধীর দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আঙুলের ছাপ নেওয়া এসব কাগজপত্র ফাইলভুক্ত করে রাখা নিয়ে। তখন এই কাজে এগিয়ে এলেন এবং সফল হলেন গণিতের ছাত্র এবং সদ্য সাব-ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ পাওয়া আজিজুল হক।

অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অনবদ্য চেষ্টার ফলে তিনি যে পদ্ধতি উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করলেন, তা-ই ‘হেনরি সিস্টেম’ বা ‘হেনরি পদ্ধতি’ নামে পরিচিতি পেলো। অ্যাডওয়ার্ড হেনরি নিজের নামেই তা চালিয়ে দিলেন। এই হেনরি রহস্যের জট খুলতে লেগে গেছে ১০০ বছর। অবশ্য সেসময় তার কাজের পুরস্কার হিসেবে আজিজুল হককে দেওয়া হয়েছিল ‘খান বাহাদুর উপাধি’, পাঁচ হাজার টাকা এবং ছোটখাটো একটা জায়গির। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন পুলিশের এসপি। অবিভক্ত ভারতের চম্পারানে (বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের একটি জেলা যা উত্তর চম্পারান নামে পরিচিত) কেটেছে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। সেখানেই তিনি ১৯৩৫ সালে মারা যান।

২০০১ সালে প্রকাশিত কলিন বিভান তার ‘ফিঙ্গারপ্রিন্টস’ গ্রন্থে আজিজুল হকের গবেষণার মৌলিকত্ব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন, অ্যানথ্রোপমেট্রিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আজিজুল হক ভয়ানক অসুবিধার সম্মুখিন হয়েছেন। ফলে নিজেই আঙ্গুলের ছাপ তথা ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাসকরণের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেন।

তিনি উদ্ভাবন করেন একটা গাণিতিক ফর্মুলা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ৩২টি থাক বানান। সেই থাকের ৩২টি সারিতে সৃষ্টি করেন এক হাজার ২৪টি খোপ। বিভান আরও জানাচ্ছেন, ১৮৯৭ সাল নাগাদ হক তার কর্মস্থলে সাত হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশাল এক সংগ্রহ গড়ে তোলেন। তার সহজ-সরল এই পদ্ধতি ফিঙ্গারপ্রিন্টের সংখ্যায় তা লাখ লাখ হলেও শ্রেণীবিন্যাস করার কাজ সহজ করে দিয়েছে।

আজিজুল হকের এই পুরো কৃতিত্ব অ্যাডওয়ার্ড হেনরি নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছেন। আর এই পদ্ধতির নাম দেন ‘হেনরি সিস্টেম’। এমনকি তিনি ক্ল্যাসিফিকেশন অ্যান্ড ইউজেস অব ফিঙ্গার প্রিন্টস নামে যে বই লেখেন, তাতেও বেমালুম চেপে যান আজিজুল হকের নাম। ব্রিটিশ সরকারও যথারীতি স্বীকৃতি দিলেন এই পদ্ধতিকে।

এর অল্প দিনের মধ্যেই কলকাতায় স্থাপন করা হলো বিশ্বের প্রথম ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো’। এই সংস্থা গড়ে তোলার বেশ পরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে একই ধরনের আরও একটি ব্যুরো গড়ে তোলা হয়। আমেরিকাতেও গড়ে ওঠে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান। তবে বেশ পরে।

আর আজ বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো বা সংস্থা গড়ে ওঠেনি, যেখানে অনুসৃত হয় না আজিজুল হক উদ্ভাবিত ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের শ্রেণীবিন্যাসকরণ পদ্ধতি।

কারেন্ট সায়েন্স সাময়িকীর ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি সংখ্যায় জিএস সোধী ও যশজিৎ কাউর ‘দ্য ফরগটেন ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ারস অব ফিঙ্গারপ্রিন্ট সায়েন্স’ শীর্ষক যে দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন, তাতে তারা হাতের ছাপ বা ফিঙ্গার প্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাসকরণের ক্ষেত্রে খান বাহাদুর আজিজুল হকের অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করে বলেছেন, এক্ষেত্রে তার অবদান সবচেয়ে বেশি।

শুধু তা-ই নয়, তারা স্যার অ্যাডওয়ার্ড হেনরির মুখোশ উন্মোচন করতেও দ্বিধা করেননি। তাদের দু’জনের লেখা ওই নিবন্ধ থেকে এও জানা যাচ্ছে যে আজিজুল হক তার কাজের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদনও করেছিলেন।

কিন্তু তার সেই আবেদন ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। বিশেষত অ্যাডওয়ার্ড হেনরি যত দিন কর্মসূত্রে ভারতে ছিলেন, তত দিন এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করার কোন ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

কিন্তু হেনরির বিবেকের জ্বালা বোধ হয় ছিল। সেই জ্বালা বা যন্ত্রণা থেকেই তিনি ১৯২৬ সালের ১০ মে ইন্ডিয়া অফিসের তখনকার সেক্রেটারি জেনারেলকে এক চিঠি মারফত জানাচ্ছেন, ‘আমি এটা পরিষ্কার করতে চাই যে আমার মতে, শ্রেণীবিন্যাসকরণ (ফিঙ্গারপ্রিন্ট) পদ্ধতিকে নিখুঁত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আমার কর্মচারীদের মধ্যে তিনি (আজিজুল হক)। সময়ের পরীক্ষায় সেই পদ্ধতি উত্তীর্ণ হয়েছে এবং বেশির ভাগ দেশ তা গ্রহণ করেছে।’

প্রশ্ন উঠতে পারে কেন ৩০ বছর পর আজিজুল হকের অবদানের স্বীকৃতি দিলেন তিনি? এত দিন কেন দেননি? জবাবে বলা হচ্ছে, প্রথমত হকের পদোন্নতি এবং দ্বিতীয়ত ভারতীয় জনগণের ওপর তত দিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভাব খর্ব হওয়ার বিষয়টি। যদি হেনরির গোপনীয়তা হক বা তার অন্য সহকর্মীরা ফাঁস করে দেন! সম্ভবত এই ভয় থেকেই আজিজুল হকের অবদানের কথা বেমালুম চেপে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

এখন দিবালোকের মতো এটা স্পষ্ট যে কথিত ‘হেনরি সিস্টেম’ আর হেনরির নয়। এখন আজিজুল হকের ভক্ত ও অনুসারীরা ফিঙ্গারপ্রিন্টের এই পদ্ধতিকে ‘হেনরি-হক-বোস সিস্টেম’ বলে অভিহিত করছেন।

উল্লেখ্য, হেমচন্দ্র বোস ছিলেন আজিজুল হকের সহকর্মী। এ ক্ষেত্রে তারও অবদান কম নয়। আমেরিকার সেন্ট লুইসে বসবাসকারী আজিজুল হকের প্র-প্রপৌত্রী ব্রিট ফেন্সি আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বোসের ওপর কাজ করে যাচ্ছেন।

ব্রিটেনের ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি’ ফেন্সির উদ্যোগে চালু করেছে ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি আজিজুল হক অ্যান্ড হেমচন্দ্র বোস প্রাইজ’। যারা ফরেনসিক সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সবিশেষ অবদান রাখবেন, এ পুরস্কার দেওয়া হবে তাদেরই।

সে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিস্টেমটিই এখন আরো আধুনিক হয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে সিকিউরিটি লক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here