বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে উদ্যোক্তা হওয়ার বিশাল সম্ভাবনা, তেমনি রয়েছে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও বাধা। গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের জন্য নিরাপদ ও নারীবান্ধব বাজার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নারীদের সরাসরি বাজার ব্যবস্থায় অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে।

সম্প্রতি সকালে ঢাকার গুলশানে বাজার ব্যবস্থাপনা এবং নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের নিয়ে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত এক ন্যাশনাল কলোকিয়ামের উদ্বোধনী পর্বে বক্তারা এমন মন্তব্য করেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ শেখ আজিজুর রহমান বলেন, দেশের অগ্রগতিতে নারীদের অবদান অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সদা তৎপর বলেও তিনি জানান।

তিনি বলেন, পোল্ট্রির পাশাপাশি ডেইরি খাতেও রয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের কাজ করার বিশাল সুযোগ। তিনি বলেন, উৎপাদিত পণ্যের বিপণন জোরদার করা জরুরি। উদ্যোক্তাদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। তবে শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন বেসরকারি উদ্যোগও।

উদ্বোধনী পর্বে নিজের গল্প তুলে ধরেন পটুয়াখালীর রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, স্থানীয় বাজারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। পূর্বে সরাসরি মূল বাজারে গিয়ে বিক্রি করার সুযোগ না থাকায় মধ্যস্বত্তভোগীদের কারণে নারী কৃষক ও উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি সরকারের কাছে নারী কৃষকদের মূল বাজার ব্যবস্থার সাথে সরাসরি যোগসূত্র তৈরির মাধ্যমে নারী কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের দাবি জানান।

আরেক নারী উদ্যোক্তা হালিমা বেগম জানান, একশনএইড বাংলাদেশ-এর মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডাব্লিউডাব্লিউ) প্রকল্পের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি সবজি চাষ শুরু করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় প্রশাসন ও একশনএইড বাংলাদেশ-এর সহায়তায় তিনটি কালেকশন পয়েন্টের মাধ্যমে উৎপাদিত সবজি বিক্রয় করে অর্থ উপার্জনে সক্ষম।

বগুড়ার নারী উদ্যোক্তা শিরিন বেগম জানান, গ্রামীণ নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে একদিকে যেমন নির্যাতনের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাবে তেমনি নারী-পুরুষ উভয়ের উপার্জনে সংসারে আসবে সমৃদ্ধি। তিনি জানান যে, তার মাসিক আয় বর্তমানে ১৫-২০ হাজার টাকা। এই অর্থ তিনি তার সন্তানের শিক্ষা ও সুন্দর ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করেন।

উদ্বোধনী আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ওয়ার্ল্ড ভিশন-এর প্রোগ্রাম পরিচালক টনি এম গোমেজ। তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আর এর পেছনে ভূমিকা রাখছে নারীর ক্ষমতায়ন ও মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন। নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তন আসছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর বৃহত্তর অংশগ্রহণ ও সমতা নিশ্চিত করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাকে নারীবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে।

এসকেএস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল আহমেদ লিটন বলেন, গ্রামীণ নারীদের আগ্রহ থাকলেও উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে তারা মূল বাজারের সাথে যুক্ত হতে পারেন না। দক্ষতা থাকা স্বত্তেও তারা জানতেন না কিভাবে সেই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আয়-উপার্জন করা যায়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। এই কর্মসূচির আওতায় নারীদের বাজার ও ব্যাংকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেয়া হয়েছে। তবে এখনো আরো অনেক কিছু করার আছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারীদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এই কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় এক হাজার পরিবারে নারী উদ্যোক্তা তৈরী হয়েছে যারা শুধু নিজেদের ক্ষমতায়নই নিশ্চিত করে নি বরং অন্যান্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। যার ফলে উন্নয়ন ঘটেছে ছয় হাজারেরও বেশি পরিবারের।

একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, বাংলাদেশের নারীরা অনেক সচেতন এবং অবস্থার উন্নয়নেও তারা অনেক বেশি সচেষ্ট। কিন্তু তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত বাজার ব্যবস্থাপনা। আমাদের গ্রামীণ কৃষি উদ্যোক্তারা, বিশেষ করে নারীরা যেন উপযুক্ত পরিবেশ পায় এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সরাসরি অংশ নিতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষকে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

একশনএইড বাংলাদেশে-এর ‘মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ)’ প্রকল্প বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় যাতে নারী উদ্যোক্তারা তাঁদের ব্যবসা সুচারু রূপে এবং নির্দ্বিধায় পরিচালনা করতে পারেন তার জন্য কাজ করে আসছে। প্রকল্পের চার বছরের শেষ পর্যায়ে এসে নারী উদ্যোক্তাদের সক্ষমতার বৃদ্ধির লক্ষ্যে মার্কেট লিটারেসি, ব্যবসা ও হিসাব ব্যবস্থাপনা এবং বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি পুষ্টি এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ে নারী উদ্যোক্তাদের তথা কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতন করা হয়েছে। একইসাথে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি ও সরকারি সেবাসমূহের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে করে প্রয়োজনে সেবা প্রাপ্তির বিষয়সমূহ নিশ্চিত হয়। জাতীয় কলোকিয়ামটি একই ধরনের কাজ করা সংগঠনগুলোর সাথে বাজার ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী এক্টরদের সাথে সমন্বয় সাধন এবং শিখন বিনিময়ের মাধ্যমে সমঝোতার লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here