হিজড়া, বৃহন্নলা, কিন্নরী কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজে এরা নানাভাবে অবহেলিত, অবাঞ্ছিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে এদের মধ্যেও কেউ কেউ ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন, হচ্ছেন প্রতিষ্ঠিত। সেই কাতারের একজন শুভা সরকার। এই জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর লক্ষ্য রয়েছে তার। লাঞ্ছনা-বঞ্চনার মাঝেও নিজেকে গড়ে তুলেছেন উদ্যেক্তা হিসেবে।
তিনি বলেন, হিজড়া হওয়ার কারণে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে কি থেমে থাকবেন? তিনি মনে করেন জীবন মানে যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে জয়ী হতে সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হবে।
শুভা সরকার নিজের গল্পের শুরুতে বলেন, বিভিন্ন সূত্রে তিনি জানতে পারেন ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি হাবিবুর রহমান সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করে থাকেন। এক বান্ধবীর মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছান শুভা। ডিআইজি হাবিবুর রহমান তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কি রান্নার কাজ করতে পারবে? তোমার কি এটা নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে?’ জবাবে শুভা বলেন, অবশ্যই পারবেন এবং সুস্বাদু খাবার রান্না করতে পারবেন। তার কথায় ভরসা করে ডিআইজি হাবিবুর রহমান শুভাকে কিছু নগদ টাকা দেন খাবারের দোকান দেয়ার জন্য। ২০১৯ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি সেই টাকায় শুভা গড়ে তোলেন ‘উত্তরণ ফুড কর্ণার’ নামের খাবারের দোকান। এখান থেকেই তার উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা শুরু।
”প্রতিটি সফলতার পেছনেই ব্যর্থতারও অনেক গল্প থাকে। আমি শুরুতে একটানা দুই মাস দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমি হিজড়া দেখে কোনো কাস্টমার আমার দোকানে আসতো না। যে কজন আসতো, খাবার দেখে নানান কথা বলতো। খাবার খেতে ভয় পেতো, বলতো যদি খাবারে কিছু মেশানো থাকে? আমি অনেক কষ্ট পেতাম এমন কথায়, তারপরও আমি ধৈর্য্য হারাই নি”- ব্যবসা শুরু প্রসঙ্গে এমনটায় বললেন উদ্যোক্তা শুভা সরকার।
উদ্যোক্তা শুভা ব্যবসায়ীক সমস্যার সমাধান নিয়ে বলেন, প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রেই সমস্যা আছে, কিন্তু থেমে থাকলে হবে না। নিজের ব্যবসায়ীক খাবার আরো সুস্বাদু তৈরী করে গ্রাহকদের খাবারের প্রতি আকর্ষিত করে ফুড কর্ণারের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে ফেসবুক পেজে বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেন শুভা। আশপাশের বন্ধুদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন নিজের ফুড কর্ণারের প্রচারণা। তারপর দূরদূরান্ত থেকে সেই ফেসবুক বন্ধুরা তার ফুড কর্ণারের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ঝাল চিকেন ফ্রাই, বার্গার, চাওমিন, সাসলিক, ভেজিটেবল রোল ইত্যাদি সব ধরনের ফাস্টফুড খাবারের প্রশংসা করে ছড়িয়ে দেন বিভিন্ন জায়গায়। অনেক শিক্ষার্থীরাও তার ফুড কর্ণারের খাবার খেতে শুরু করে। ব্যবসায় সফলতার মুখ দেখতে শুরু করলেন উদ্যোক্তা শুভা সরকার।
শুভা জানান, গ্রাহকের সংখ্যা এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খাবারের মান ও স্বাদ বৃদ্ধি করা তার চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্য সম্মতভাবে সব সময় খাবার তৈরি করার চেষ্টা করেন তিনি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে শুভা সরকার বলেন, ঢাকার আফতাবনগর এলাকায় আরেকটি ফুড কর্ণার প্রদর্শনের চেষ্টায় আছেন।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, তার মত এভাবেই যেন সকল বঞ্চিত মানুষ উদ্যোক্তা হয়ে ধৈর্যের সঙ্গে পথ চলে। সততার সঙ্গে কোনো কাজ করলে কখনই কেউ থমকে যাবে না।
তিনি বলেন, সবাই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পাশে দাঁড়ালে এই গোষ্ঠীর মানুষেরা পিছিয়ে থাকবে না। দেশকে এগিয়ে নিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তিনি।
শুভা সরকার বলেন, সমাজের বিত্তবান লোকেরা যদি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পাশে দাঁড়ায় তাহলে এই গোষ্ঠী পিছিয়ে থাকবে না। তিনি ডিআইজি হাবিবুর রহমানকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান।
মেহনাজ খান
উদ্যোক্তা বার্তা ঢাকা