প্রকৌশলী ও প্রোডাক্ট ম্যানেজার থেকে গুগল প্রধান সুন্দর পিচাই

0

১৯৭২ সালের ১০ জুন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাইয়ের মাদুরাইতে জন্মগ্রহণ করেন সুন্দর পিচাই। পুরো নাম পিচাই সুন্দররাজন । বাবা রঘুনাথ পিচাই একটি ব্রিটিশ সংস্থায় তড়িৎ প্রকৌশলী মা লক্ষ্মী পিচাই ছিলেন শ্রুতিলেখক। ছোট সংসারে পিচাইয়ের সঙ্গী ছিলো ছোট ভাই। শিক্ষিত পরিবারটি আর্থিকভাবে খুব যে স্বচ্ছল ছিল, তা-ও বলা যাবে না। দুই রুমের ছোট্ট এক বাড়িতে থাকতেন ওদিকে সুন্দর ছিলেন ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী। ছোটবেলায় বাড়ির ল্যান্ডফোনে একবার ডায়াল করা যেকোনো নম্বরই হুবহু মনে রেখে বাবা-মাকে চমকে দিতেন।

ক্রিকেটভক্ত সুন্দর ছিলেন স্কুলের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক।বিখ্যাত এ প্রযুক্তিবিদের হাতে মোবাইল ফোন কিন্তু তাঁর বাবা-মা ১২ বছর বয়স অবধি তুলে দেননি। এভাবেই চেন্নাইয়ের জহর বিদ্যালয়ে শিক্ষার হাতেখড়ির দিন কাটবার পর পদ্ম সেশদ্রি বালা ভবন থেকে অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন সুন্দর। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে তুখোড় ফলাফল করে মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি.টেক করবার সুযোগ পান ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৌশল বিদ্যাপীঠ আইআইটি খড়গপুরে। আইআইটিতে ভর্তির আগেই সফটওয়্যার তৈরিতে ঝোঁক ছিলো সুন্দরের। তাঁর বানানো প্রথম সফটওয়্যারটি ছিলো একটি দাবার গেমের অ্যাপ্লিকেশন। ব্যাচেলরের পাঠ চুকিয়ে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি বৃত্তি পেলেন সুন্দর।

যুক্তরাষ্ট্রে পা রেখেছিলেন একটা সুপ্ত বাসনা থেকে, তা হলো ক্যালিফোর্নিয়ার প্রযুক্তি-স্বর্গ সিলিকন ভ্যালিকে তিনি পেতে চান নিজ কর্মস্থল হিসেবে। সেই স্বপ্নের দেশের ক্যালিফোর্নিয়ায় জিনিসপত্রের দামে তাঁর মাথা খারাপ হবার যোগাড়, ওই সময় আইএসডি কলের জন্য মিনিটে 2 ডলার খরচ পড়ত। সেই কারণে বাড়িতে ফোন করতে পারতেন না তিনি ওদিকে ৬ মাস কথা বলতে না পেরে বান্ধবী অঞ্জলিকেও প্রচণ্ড মিস করছিলেন সুন্দর। আমেরিকায় গিয়ে প্রথমবার কম্পিউটার দেখেন পিচাই, ভর্তি হলেন স্ট্যানফোর্ডে।
সুন্দরের অধ্যাপক তাঁকে পিএইচডির জন্য সুপারিশ করলেও সুন্দর পিএইচডি না করে সেখান থেকে ধাতব বিজ্ঞান ও অর্ধপরিবাহী পদার্থবিজ্ঞানের ওপর মাস্টার্স করলেন। পিএইচডি করতে এসেও ড্রপ-আউট হলেন সুন্দর। তারপর সিলিকন ভ্যালিতে অ্যাপ্লাইড ম্যাটিরিয়ালস নামে একটি অর্ধপরিবাহী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী ও প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে চাকরি নেন। বেশিদিন অবশ্য সেখানে টেকেননি সুন্দর। অন্যদিকে এমএস করতে আমেরিকায় হাজির সুন্দরের প্রেমিকা অঞ্জলি। তখনই বিয়েটা সেরে নেন তাঁরা।

এরপর পামার বৃত্তি নিয়ে ২০০২ সালে পেনিসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ারটন স্কুল থেকে এমবিএ করেন সুন্দর। প্রথম চাকরি নিলেন ম্যাককিনসে এন্ড কোম্পানিতে ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে।
২০০৪ সাল
গুগলপ্লেক্সে যেদিন প্রথম ইন্টারভিউ, দিনটি ছিলো একটু উদ্ভট- এপ্রিল ফুল দিবস! কাকতালীয়ভাবে সেদিনই জিমেইল চালু করে গুগল। সেদিন তিনি সহ অন্যান্য চাকরিপ্রার্থীরাও ভেবেছিলেন মার খেতে যাচ্ছে গুগলের এই প্রজেক্ট! প্রথম দফাতেই চাকরিটা হয়ে গেলো সুন্দরের।

গুগলের সার্চ টুলবার নিয়ে কাজ করবার গঠনকৃত ছোট একটি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হলে সেখানেই গুগল-যজ্ঞের অভিষেক ঘটে সুন্দর পিচাইয়ের।
টুলবারের গুরুত্বে ২০০৬ সালে হঠাৎ করেই বাধ সাধলো মাইক্রোসফট। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারে ডিফল্ট করে দেওয়া হলো বিং-কে। তখন নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য নেতিবাচক এ পরিবর্তনের কার্যকরী ফলাফল প্রশমিত করতে কম্পিউটার নির্মাতাদের তিনি সম্মত করলেন তাদের হার্ডওয়্যারে টুলবার প্রি-ইনস্টল করার। ফিরে এলো টুলবারের রাজত্ব।

গুগলের সার্চ টুলবারের সাফল্যই ছিলো সুন্দর পিচাইয়ের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া মুহূর্ত। এর মাধ্যমেই তিনি গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিন এর প্রিয়পাত্র বনে যান। ফলে, সুন্দর কর্তৃক গুগলের নিজস্ব ব্রাউজার তৈরির পরিকল্পনায় সায় দিয়ে দেন তাঁরা।
২০০৮ সাল
চলে এলো ‘গুগল ক্রোম’। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মাইক্রোসফটের ইন্টারনেট ইক্সপ্লোরার ও মজিলা ফায়ারফক্সকে ছাপিয়ে ব্রাউজারের দুনিয়ায় একক আধিপত্য বিস্তার করে ক্রোম। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ক্রোম সিরিজ হিসেবে বাজারে আসে ক্রোম ওএস, ক্রোমবুকস ও ক্রোমকাস্ট। ক্রোমের কৃতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ সে বছরই পণ্যোন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সুন্দর। চার বছরের মাথায় ক্রোম ও অ্যাপ বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বনে যান তিনি।

২০১৩ অ্যান্ড্রয়েডের জনক অ্যান্ডি রুবিন কর্মস্থল ছেড়ে দিলে ল্যারি পেজ সুন্দর পিচাইকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন। ল্যারি পেজের দূরদৃষ্টি বেশ ভালো পড়তে পারতেন সুন্দর পিচাই। গুগলের দায়িত্বে তিনি এতটাই নিষ্ঠাবান ছিলেন যে, টুইটার কর্তৃক একাধিকবার ‘লোভনীয়’ সুযোগ হাসিমুখে প্রত্যাখ্যান করেছেন । সফলতা ও সততার প্রতিদানস্বরূপ ২০১৪ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যারি পেজের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড, অর্থাৎ গুগলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ ‘প্রোডাক্ট চিফ’ ঘোষিত হন সুন্দর পিচাই। গুগল টুলবার, গুগল ক্রোম, ডেস্কটপ সার্চ, গুগল গিয়ারস, ফায়ারফক্স এক্সটেনশন ইত্যাদি নানা প্রোডাক্টের দায়িত্ব পান তিনি।
“সামনে কী হতে যাচ্ছে, তা দেখবার এক অসীম ক্ষমতা আছে সুন্দরের, সেই সাথে আছে একটি বিশাল কর্মীদল ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে সংহত করবার দক্ষতা।”

সুন্দরের প্রোমোশনের দিন ঘোষণাপত্রে সুন্দরকে ল্যারি পেজ উল্লেখ করেন ‘পারফেক্ট ফিট ফর দিস রোল’। অনুমিতভাবেই ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট গুগলের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)-ঘোষিত হন সুন্দর।

সিইও হয়ে তাঁর নতুন চ্যালেঞ্জ গুগলের নয়া অবতার অ্যালফাবেট ইনকর্পোরেটেডকে দাঁড় করানো। গুগল অধীনস্থ সকল কোম্পানি-প্রোডাক্টকে এক সুতোয় গাঁথতে এ কোম্পানি গড়েছে গুগল স্বয়ং। গুগল ক্লাউড, ইউটিউব থেকে শুরু করে এআই সব কিছুতেই সুন্দর পিচাইয়ের অবদান অসামান্য

২০১৬ সালে সুন্দর পিচাই আয় করেছিলেন ১৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১,৬৬০ কোটি বাংলাদেশী টাকা), যা ২০১৫ এর আয়ের দ্বিগুণ। ২০১৬-তে তাঁর নির্ধারিত মাসিক বেতন ছিলো সাড়ে ৬ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। এর বাইরেও তহবিল, লভ্যাংশসহ নানা খাত থেকে প্রতি মাসে আরো মোটা অঙ্ক আয় করেন সুন্দর। ২০১৬ সালে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিলো ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে ভারতীয় মুদ্রায় 1884 কোটি 39 লাখ 13 হাজার 900 টাকা বেতন পেয়েছেন তিনি। মার্কিন সংবাদ সংস্থাগুলির দাবি, বর্তমানে তাঁর মোট সম্পত্তি পরিমাণ প্রায় 5400 কোটি টাকা। 2022 সালে, ভারত সরকার থেকে বাণিজ্য ও শিল্প বিভাগে তৃতীয়-সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ পেয়েছেন পিচাই।

প্রেমিকা অঞ্জলিকে বিয়ে করে আগেই সফল প্রেমিকের খাতায় নাম লেখানো সফল কর্মজীবী সুন্দর এক কন্যা ও এক পুত্রের জনক। তাঁর সাফল্যমণ্ডিত উত্থানে স্ত্রীর রয়েছে বিশাল অবদান। মাইক্রোসফট, ইয়াহু ও টুইটারে মোটা অঙ্কে সিইও হবার অফার পেয়েও গুগলে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্ত্রী অঞ্জলির অনুপ্রেরণাতেই।

ইনস্টাগ্রাম তো একেবারেই নয়, টুইটারেও অনেক কম সক্রিয় সুন্দর পিচাই কেবল গুগল প্লাসে কিছুটা সময় দিয়ে ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর ফেলছেন সুন্দর পিচাই।

ব্যক্তিজীবনে খুবই মিতভাষী কিছুটা গোবেচারা এবং একইসাথে রাশভারী মনে হলেও আসলে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, বন্ধুত্বপরায়ণ ও পরোপকারী হিসেবেই কাছের লোকদের কাছে পরিচিত। এখনো প্রায়ই ভিডিও কনফারেন্সে নিজের আইআইটি খড়গপুরের জুনিয়রদের সাথে কথা বলেন সুন্দর। আমাদের এই চেনা উপমহাদেশেরই একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেখান থেকেই বিশ্বের অন্যতম কর্পোরেট অধীশ্বর। এ যেন অনেকটা ঘরের পাশের ছেলের বিশ্বজয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here