‘গ্রাম থেকে একদম খাঁটি জিনিস নিয়ে কাজ করার মত সুযোগ আমার আছে। যে খাঁটি জিনিসটা আমি পাচ্ছি সেটা অবশ্যই সবাইকে দিতে পারবো সেই বিশ্বাস থেকে এবং ভেজালের ভিড়ে খাঁটি জিনিস খুঁজতে খুঁজতে নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে গেলাম’-এমনটাই বলছিলেন উদ্যোক্তা সুমাইয়া সুলতানা খুশি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘খুশির বাজার’ নামে একটি পেইজে বাহারি খাঁটি পণ্যের পসরা বসিয়েছেন তিনি। খাঁটি ঘি, মধু, প্যারা সন্দেশ, মাখন, সরিষার তেল, নারিকেল তেল, খেজুরের পাটালি এবং ঝোলা/ লিকুইড গুড় নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সুমাইয়া। এমন খাঁটি পণ্য হাতের মুঠোয় পেয়ে গ্রাহকেরা ব্যাপক তৃপ্ত।
সুমাইয়ার গ্রামের বাড়ি পাবনায়। ছোট বেলা থেকেই গ্রামীণ আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেন তিনি। গ্রামের মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, মেঠো পথ, গাছপালা – প্রাকৃতিক আবহাওয়ার নির্মল পরিবেশে বড় হয়েছেন। গ্রামের সতেজ এবং ভেজালমুক্ত খাবারে অভ্যস্ত, তাই তো পাবনা থেকে ঢাকা আসার পর ভেজালের ভিড়ে খাঁটি পণ্যটি খুঁজেছেন সব সময়। যেহেতু গ্রামে বেড়ে উঠা তাই তিনি জানেন কোথায় গেলে তিনি খাঁটি পণ্যটি পাবেন। তাইতো খাঁটি পণ্য সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।
খাঁটি পণ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সুমাইয়া উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, ‘আমি পাবনার ভেজালমুক্ত খাঁটি পণ্য নিয়ে কাজ করি। আমার পণ্যের প্রত্যেকটা কাজ আমি নিজে বসে থেকে করাই, অধিকাংশ সময় নিজেই হাত লাগাই। এখন আমি বেশ কিছু মানুষের কর্মস্থানের সুযোগ করে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, শুরুতে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে সতেরোটা ঘোষালের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাজ দেখে ঘি সম্পর্কে বিস্তর তথ্য নিই। তারপর সঠিক জায়গা থেকে সরাসরি নিজের তত্ত্বাবধানে ঘোষদের সঙ্গে থেকে ঘি তৈরি শুরু করি। আদি সনাতন পদ্ধতিতে বংশপরম্পরায় তৈরি হচ্ছে এই ঘি। এছাড়াও পাবনার প্যারা সন্দেশ খুবই বিখ্যাত। তাই সম্পূর্ণ নিজের তত্ত্বাবধানে ময়রার সাথে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা চুলার আগুনের উত্তাপ সহ্য করে প্যারা সন্দেশ তৈরি করেছি। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে এই মজাদার প্যারা সন্দেশ। খাঁটি এবং ভেজালমুক্ত পণ্য নিশ্চিত করতেই নিজেদের জমিতেই সরিষার কাজ শুরু করেন। নিজের জমিতে উৎপাদিত ফসল প্রক্রিয়াকরনের মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন ভেজালমুক্ত সরিষার তেল। ক্রেতা পাচ্ছেন আসল সরিষা তেলের স্বাদ। মধু নিয়ে কাজ করার সময় মধু সংগ্রহের জন্য চলে যেতাম একদম প্রত্যন্ত গ্রাম গুলোতে যেখানে তেমন রাস্তাঘাট নেই। বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া যাওয়া যায় না। কখনো নৌকায়, কখনো মহিষের গাড়িতে আবার কখনো মাইলের পর মাইল হেঁটে কাদা পায়ে, জঙ্গলে, বিলের ধারে, নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে – মধু সংগ্রহ করতাম।
এরপর শীতে শুরু করলাম খেঁজুরের রস, খেঁজুরের পাটালি এবং ঝোলা/ লিকুইড গুড় নিয়ে কাজ। চিনি, হাইড্রক্স, ফিটকিরি ও কেমিক্যালমুক্ত গুড় তৈরির লক্ষ্যে নিজস্ব খেঁজুরের গাছ থেকে নিজেদের গ্রামেই গুড় তৈরি শুরু, বেশ ভালো সাড়াও পাই। মাত্র ৩ মাসে ১ হাজার ৬০০ কেজি গুড় বিক্রি করি।
তিনি আরও বলেন, যখন পণ্য হিসেবে নারিকেল যুক্ত করি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারকেল সংগ্রহ করে লোক দিয়ে হাতে কেটে রোদে শুকিয়ে কাঠের ঘানিতে তেল তৈরি করা শুরু করি। এর পর শুরু করি মাখন নিয়ে কাজ। পাবনা থেকে দুধের ক্রিম নিয়ে এসে নিজের হাতেই মাখন তৈরি করি।
উদ্যোক্তা সুমাইয়া সুলতানা খুশি মাত্র পাঁচ হাজার ২২০ টাকার পুঁজি দিয়ে উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রতিমাসে বিক্রি করছেন কমপক্ষে তিন লাখের বেশি টাকার পণ্য।
নিজের সফলতার পেছনে রয়েছে এক প্রকারের যুদ্ধ। উদ্যোক্তা সুমাইয়া সুলতানা বললেন, ‘‘আমি সফল হতে চেয়েছি বলে আজ আমি ছুটে চলেছি অদম্য গতিতে। কোনো ভালো কাজ করতে গেলে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে পণ্য প্যাকেজিং এবং ডেলিভারি নিয়ে। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয়টা হলো এই এত্ত কিছু সব আমি একা করি। আমি চাই, ঢাকার মধ্যে ‘খুশির বাজার’ এর একটা আউটলেট থাকবে। যেখানে সব ভেজালবিহীন খাবার থাকবে সব জায়গায় ভেজালভুক্ত পণ্য ছড়িয়ে দিতে চাই’’।
উদ্যোক্তা জানালেন, কাজের নিজস্বতা থাকলে আর কোয়ালিটি ভালো হলে সেই কাজে সফল হওয়া যায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাজে ভাল সাড়া পেয়ে দেশের বাহিরেও পণ্য পাঠিয়েছি।
উদ্যোক্তার রিপিট কাস্টমারের সংখ্যাই বেশি। এখন অনেক নতুন উদ্যোক্তাদের পাইকারি পণ্য সরবরাহ করছেন তিনি।
সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা