বাবা কাতারের পুলিশ অফিসার ছিলেন। তার মৃত্যু মেনে নেয়াটা জীবনের প্রথম সংগ্রাম ছিলো। মা গৃহিণী। কিন্তু বাবা যখন বিদেশ ছিলেন তখন থেকে এখন পর্যন্ত পরিবারের সবাইকে এক শাড়ির আঁচলের নিচে আগলে রেখেছিলেন। ভাই-বোন চারজনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। চট্টগ্রাম রাউজান থানায় হালদারপার গ্রামের বাড়ির মাধ্যমে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বেড়ে উঠা উদ্যোক্তা রাবেয়া আনজুম সামিরা’র। তিনি চট্টগ্রাম কলেজের (বি.এস.সি) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা শুরু ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি ‘সাজে নকশা’ অনলাইন পেজ খোলার মধ্য দিয়ে। তিনি মূলত হাতের তৈরী গহনা, গায়ে হলুদের গহনা, বিয়ের গহনা, রেসিন গহনা, ক্লে গহনা, হাতের চুরি, ব্রেসলেট, কানের দুল, নুপুর, ফিঙ্গাররিং, ক্যান্ডেল, গ্লাস পেইন্টিংসহ হস্তশিল্পের অনেক রকম গিফট আইটেম। সঙ্গে দেশীয় শাড়ি, অর্গানিক ফুড, ড্রাগন ফল (নিজস্ব বাগানের), ফ্রোজেন আইটেম, মিষ্টি, দই ইত্যাদি নিয়ে সাজের নকশা, দি ক্রাফট কুফেনি, ইউনিক ক্যান্ডেল হাউস বাংলাদেশ, ফেসবুক পেজ ওপেন করে কাজ করেন।
২১ বছর বয়সে উদ্যোক্তা রাবেয়া আনজুম সামিরা যাত্রা শুরু করেন হাতে তৈরী গহনা দিয়ে। বিয়ে হয় ২০১৫ সালের জুনের ৫ তারিখ। সামিরা ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন রকম হাতের তৈরী পণ্যের প্রতি অধীর আগ্রহের কথা শুনে এবং বাস্তবতা দেখে শুরু করেছিলেন। এরপর তার স্বামী তাকে বলেন, ইউটিউবে একটি চ্যানেল ওপেন করতে। সেই ইউটিউব চ্যানেল ওপেন করতে গিয়ে উদ্যোক্তা হওয়া শুরু। পরবর্তীতে ইউটিউবার আর হয়ে ওঠেননি কিন্তু উদ্যোক্তা ঠিকই হয়ে উঠেছিলন। এখনোও তিনি ইউটিউবার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
উদ্যোক্তা বলেন, শুরুর দিকে পুঁজি ছিলো মাত্র ৫০০ টাকা। বর্তমানে পাঁচ লাখেরও বেশি। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব তিনি একা হাতেই সামলিয়ে এসেছেন। পণ্য তৈরীর কাঁচামাল সংগ্রহ, পণ্যের গুণগত মান যাচাই, পণ্য নিজের হাতে মেধা খাটিয়ে বানানো হয়, পণ্যের ছবি তোলা, তা ফেসবুকে সঠিক সময়ে পোস্ট করা, কাস্টমারের সঙ্গে কথোপকথন, প্যাকেজিং এবং ডেলিভারি দেওয়া সম্পূর্ণ ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তিনি একাই করে এসেছেন।
তিনি বলেন, ২০১৮ দ্বিতীয় পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এই ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে উদ্যোক্তা অনেক কষ্ট হলেও এই উদ্যোগ যা তার জীবনের কাছে অনেক বেশি আনন্দের কারণ এবং তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন। সংসারে সব কাজ গুছিয়ে সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে অনেক রাত জেগেছেন। সারারাত না ঘুমিয়ে সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের কাজে হাত দিয়েছেন। যখন শুরু করেন তখন থেকে এখন পর্যন্ত অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে টিকে আছেন।
তিনি বলেন, বিশেষভাবে আল্লাহ পাকের কাছে কৃতজ্ঞ, সেই সঙ্গে স্বামী এবং মায়ের সাপোর্ট যদি না থাকতো তাহলে হয়তো এতো অল্প বয়সে সব কিছু সামলিয়ে এতদূর আসা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। ৫ বছরের উদ্যোক্তা জীবন থলিতে জমেছে অনেক মানুষের ভালবাসা এবং দোয়া।
রাবেয়া আনজুম বলেন, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ মাসব্যাপী একটি সরকারি ক্যান্ডেল কোর্স করেন। সেখানে লিখিত ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার ফল ছিলো এ প্লাস। তারপরই অনলাইনে ক্যান্ডেলের কোর্স করেছেন। আশপাশের অনেক নারীকে শিখিয়েছেন। ক্যান্ডেল কোর্স নিয়ে অনেক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে। ২০১৯ সালে আমি সাজে নকশা চার বছর ফুর্তি উপলক্ষে অক্টোবর ৭, ১৭, ১৮, ১৯ তারিখ চিত্রাংকন ও আবৃতি প্রতিযোগিতা এবং তিন দিনব্যাপী একটি উদ্যোক্তা মিলন মেলার আয়োজন করেন। যেখানে ১৫০ জনেরও বেশি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং উদ্যোক্তা মিলনমেলায় অনেক অভিজ্ঞ উদ্যোক্তাসহ প্রায় ৬০ জন উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ করেছিলেন। একাই সব কিছু আয়োজন করেন তিনি।
তিনি জানান, ২০১৯ সালে ২২ থেকে ২৪ (বি.এস.সি.আই) শিল্প সহায়ক কেন্দ্র বিসিক চট্টগ্রাম কর্তৃক আয়োজিত শিল্পোদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন তিনি। আয়োজিত মেলাসহ নানারকম সরকারি, অনলাইন, অফলাইন মেলায় স্টল নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। এরপর উদ্যোক্তার স্বামী এবং ভাই মানিকছড়ি ড্রাগন বাগান পরিদর্শন করতে যাওয়ার পথে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন। তারপরও উদ্যোক্তা জীবনের লড়াই থামিয়ে রাখেননি। আবারো কাজে নেমে পড়েন।
নতুনদের উদ্দেশ্যে রাবেয়া আনজুম বলেন, যেটা নিয়েই শুরু হোক লেগে থাকতে হবে। সংগ্রাম করে যেতে হবে, ধৈর্য্য ধারণ হচ্ছে সব থেকে বড় শক্তি উদ্যোক্তা জীবনে। হার মানা যাবে না, মন খারাপ করা যাবে না। পরিবেশ পরিস্থিতি সব সময় এক হবে না। তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। অন্যকে অনুকরণ না করে নিজের মেধা খাটিয়ে কাজ করলে আরো ভাল ফল পাওয়া যাবে। অন্যের সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতা না করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে অনেক দূর আগানো সম্ভব। পাশাপাশি যারা কটু কথা বলবে তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
মেহনাজ খান
উদ্যোক্তা বার্তা ঢাকা