আশির দশক, বরিশালের গৌরনদীর এসএসসি পরীক্ষার্থী কিশোর মেরাজ হোসেন খান পরীক্ষা দিতে বের হচ্ছিলেন। এমন সময় বাড়িতে এলো বাবার লাশ। বাবার মৃত্যুতে সেদিন তার আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। দিশেহারা পরিবারে কথা ভেবে বইখাতা তুলে রেখে কলমের পরিবর্তে তাকে শক্ত হাতে ধরতে হয়েছে পরিবারের হাল। বড়, মেঝো, ছোট তিন ভাই মিলে শুরু করলেন টেইলারিং এর ব্যবসা। বছর খানেক পর সেখান থেকে বেরিয়ে যান মেঝো ভাই। ভাইয়ের প্রস্থান হতবিহ্বল করে তোলে কিশোর মেরাজ হোসেন খানকে। একসময় নিজেই শুরু করলেন টেইলারিং। ১০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৫ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করলো খান টেইলার্স। ৫ টি উপজেলায় ২৬টি মেশিন বয়ে আনলো সমৃদ্ধি, সংসারে জাগলো আশার আলো। টেইলারিং ব্যবসায় ভীষণ সফলতার পর তিনি ১৮০ স্কয়ার ফিটে মেরাজ ট্রেডার্স স্থাপন করলেন। মনস্থির করলেন পাশাপাশি এমন একটি ব্যবসা করবেন যা আশপাশের কয়েকটি থানায় আগে কেউ করেনি। তারপর সাদাকালো টিভি আর ক্যাসেট রেকর্ডার দিয়ে শুরু করলেন নতুন যাত্রা। সে সময় নাম করা সাদা কালো টেলিভিশন ন্যাশনাল ও নিপ্পন নিয়ে প্রথম আউটলেট সাজালেন। চাহিদা বেড়ে গেলো। ক্যাসেট প্লেয়ার, ফিলিপস, রেডিওর নতুন ব্যবসা এক সমৃদ্ধির পথ বয়ে আনলো মেরাজ হোসন খানের জন্য। টিভি শুধু বিক্রিই নয়, টিভি সেট করে দিয়ে আসা, এন্ট্যানা লাগিয়ে দেয়া এবং সেই সাথে আফটার সেল সার্ভিস দিয়েও ব্যবসায় বেশ সুনাম কুড়ালেন উদ্যোক্তা। এরইমাঝে সনি রেংস এর প্রথম শোরুম হলো গৌরনদীতে। ১৯৯৫ সালের মধ্যেই ব্যবসা বেড়ে দাঁড়াতে শুরু করলো। এমন কোনো ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ড নেই যা মেরাজ হোসেনের ডিলারশিপে আসেনি।
২০০৩-২০০৪ সালে তোশিবা এলজি বাটারফ্লাই, স্যামসাং, রেডিও ভিশন, টিএলসি, হিতাচি, সার্ক সহ সকল পণ্যের হাব হিসেবে স্বীয় পরিশ্রম, মেধা এবং নিজের কর্ম উদ্দীপনায় বরিশাল বিভাগের মধ্যে মেরাজ ট্রেডার্স কে নিয়ে গেলেন অনন্য এক উচ্চতায়। ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে আগলঝড়া, কোটালিপাড়া, বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, মূলাদি, কালকিনী এসকল থানার মধ্যে ইলেকট্রনিক্স এ্যাপ্লায়েন্স কেনার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেরাজ ট্রেডার্সকে পরিণত করলেন উদ্যোক্তা মেরাজ হোসেন খান।
তারপর সাশ্রয়ী মূল্য আর ভালো কোয়ালিটি নিয়ে বাজারে এলো ওয়ালটনের দেশীয় পণ্য। সর্বোচ্চ গ্যারান্টি, তাৎক্ষণিক বিক্রয় এবং পণ্যের গুণগত মান ভীষণভাবে আকর্ষণ করে মেরাজকে। প্রায় ১০০০ স্কয়ার ফিটে মেরাজ ট্রেডার্স আত্মপ্রকাশ করলো রিয়াজ ইলেকট্রনিক্স নামে। শুরু থেকে এপর্যন্ত ১১টি জেলা নিয়ে ওয়ালটনের বরিশাল জোনে উদ্যোক্তার অবস্থান ১ নম্বরে। ওয়ালটনের ৭টি স্থানে ২০টি জোন হওয়ার পরেও মাদারিপুরের জোনেও প্রথম স্থান অধিকার করেছেন রিয়াদ ইলেকট্রনিক্স। ১৮০ স্কয়ার ফিট আজ গৌরনদী সুপার মার্কেটে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০০ স্কয়ার ফিটের শো রুমে। আগলছড়া উপজেলাতে তার ১০০০ স্কয়ার ফিটের আরেকটি আউটলেট রয়েছে। ২০ জন কর্মী কাজ করছেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই, চীন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইরান এমন অনেকগুলো দেশ ঘুরে এসে উদ্যোক্তা আরো প্রসার করেছেন নিজের ব্যবসা। কোম্পানি থেকে যখন বড় লরিতে করে ফ্রিজ, টিভি আসতো তখন মেরাজ হোসেন খান তার আউটলেটের সবাইকে নিয়ে একত্রে সব প্রোডাক্টগুলো নিজেই নামাতেন। অনেক সময় লরির লোক বা ড্রাইভার তাকেই প্রশ্ন করতো, এ দোকানের মালিক কে? এতটাই আত্মকর্মে বলিয়ান তিনি, এতটাই সময় দিয়েছেন নিজের ব্যবসায় এবং নিজে কর্মী হয়ে কাজ করে আজ একজন সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন মেরাজ হোসেন খান।