সারা বাংলাদেশেই সূর্যমুখী হয়, তবে উপকূলীয় এলাকায় এর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, বলছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
২০ বছর আগে থেকে পতিত জমিতে কেউ চাষ করত না। শুধু এক ফসল ছিল, আমন ধান। তারপর কৃষি অফিসারের পরামর্শে পটুয়াখালীর অসীম শিকারী এক বিঘায় সূর্যমুখী চাষ করলেন। খুব ভালো ফলন হয়। এই জমিতে কোনোদিন তিন ফসল ফলাতে পারবে এমনটা কখনো ভাবেননি অসীম।
শুধু তিন ফসলের একটি হিসেবে সূর্যমুখী চাষ নয়, বাণিজ্যিকভাবে এ ফসল চাষে নামার কথা জানান তিনি। এবার তিনি সূর্যমুখী আবাদ করছেন প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে।
গত বছর বিঘাখানেক জমিতে সূর্যমুখী চাষ করে প্রায় দেড়শ কেজি দানা (সূর্যমুখীর বীজ) পান অসীম। সেই চাষের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “এক বিঘায় প্রায় ৬০০ গ্রাম বীজ লাগে। আর এক কেজি বীজের দাম ৩৫০০ টাকা। ব্র্যাক আমার প্রায় ১২ কেজি, মানে ৩৬ হাজার টাকার বীজ দিয়েছে, সাথে বিঘাপ্রতি ১৫০০ টাকা।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে বছরে ২৪ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে।
কিন্তু এই তেলের বেশির ভাগ, প্রায় ৮৮ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ভোজ্য তেল আমদানিতে খরচ হয়েছে ২৫৩ কোটি ডলার।
বর্তমানে দেশে সরিষা, তিল ও সূর্যমূখী থেকে প্রায় ৩ লাখ টন তেল উৎপাদন হয়। বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল যাতে আমদানি করতে না হয়, সেজন্য সরকার ২০২৫ সাল নাগাদ ধানের উৎপাদন না কমিয়েই মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ, মানে ১০ লাখ টন তেল দেশেই উৎপাদন করার নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক জসীম উদ্দিন বলেন, উপকূলের সেসব পতিত জমি আছে, তাতে সূর্যমুখী ও সয়াবিন চাষের বিপুল সম্ভাবনা আছে।
‘আমাদের দেশে সরিষাটাই প্রধান, তারপর সূর্যমুখী। সারা বাংলাদেশেই সূর্যমুখী হয়, তবে উপকূলীয় এলাকায় এর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যেখানে লবণাক্ততা আছে এবং বোরো ধান করা সম্ভব না, সেখানে সূর্যমুখীটা হচ্ছে।
‘সমতল জমিতে সূর্যমুখীর জন্য জায়গা পাওয়া কঠিন। ওখানে সূর্যমুখী করলে বোরো করতে পারে না। আর লবণাক্ত জমিতে সরিষা ভালো হয় না, সয়াবিন এবং সূর্যমুখীটা বেশি হয়।”
জসীম উদ্দিন বলেন, সয়াবিনের চেয়ে সূর্যমুখীর সম্ভাবনা বেশি, কারণ এটা সরাসরি ব্যবহার করা যায়। স্থানীয় পর্যায়ে যে ঘানিগুলো আছে, সেখানে ভাঙালেই কৃষক সূর্যমুখী তেল খেতে পারছে। কিন্তু সয়াবিন থেকে সরাসরি তেল হয় না।
কয়রা উপজেলার পাটুলিয়া গ্রামের এ কৃষক জানান, অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কাটার পর মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য তার জমিতে অন্য ফসল হত না। ফলে বছরের বেশির ভাগ সময় জমি অনাবাদী হয়ে থাকত।
গতবার তেমন জমিতেই সূর্যমুখী চাষ করে প্রায় ১২৬ কেজি সূর্যমুখী দানা পান তিনি, যা ভাঙিয়ে ৩৬ কেজির বেশি তেল পেয়েছেন। আর সেখান থেকেই আরও বেশি জমিতে সূর্যমুখী চাষের উৎসাহ পেয়েছেন।
একই এলাকার ব্রতী রানী জানালেন, গত বছর তিনি ১০ কাঠা জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছিলেন। এবার আমন ধান কাটার পর প্রায় ৪ বিঘা জমিতে এ শস্য আবাদ করেছেন।
“এই তেলটা খাঁটি, সুস্বাদু। নিজেরা করে খাচ্ছি, কোনো ভেজাল নেই। আর শুনছিলাম তেলের দাম বাড়তি, তাই এবার বেশি জমিতে দিছি। তাছাড়া আমাদের এই মাটিতে সূর্যমুখী খুব ভালো হয়।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রামের মতো উপকূলীয় এলাকায় অন্তত ৯ লাখ হেক্টর লবণাক্ত জমি আছে। এসব জমির বড় অংশ এক ফসলি, নয়তো পতিত জমি।
তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক জসীম উদ্দিন বলছেন, “এই ৯ লাখ হেক্টর জমিতে যদি ঠিকভাবে চাষ করা চায়, তাহলে ১২ থেকে ১৩ লাখ মেট্রিক টন বীজ পাওয়া যাবে। আর তা ভাঙিয়ে শুধুমাত্র সেখান থেকেই ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন তেল পাওয়া সম্ভব। এখন ৪ লাখ যদি অতিরিক্ত তেল হয়, তাহলে এখান থেকে প্রায় ১৬ শতাংশ চাহিদা কাভার করা যাবে।
“আমাদের প্রতি বছর চাহিদা হল ২৪ লাখ মেট্রিক টন। আর আমাদের দেশে তো অলরেডি ১০ শতাংশ হচ্ছেই। বাড়তি আরও ১৬ হলে মোট ২৬ শতাংশ তেল সহজেই দেশে উৎপাদন করা যাবে।”
এ বছর দেশের ১৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে জানিয়ে জসীম বলেন, সরকারের লক্ষ্য হল ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশে মোট ৩৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জায়গায় সূর্যমুখীর চাষ করা। তা সম্ভব হলে শুধু সূর্যমুখী থেকেই ৫৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন বীজ, অর্থাৎ ২০ হাজার ২৯২ মেট্রিক টন তেল পাওয়া যাবে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২৮ দশমিক ৬ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ১০ দশমিক ৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা কবলিত। ফলে রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে ফসল চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। ওই সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততা ২৫-৩০ ডিএস/মি পর্যন্ত দেখা যায়।
ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা