নিজে স্বাবলম্বী হয়ে ১২ হাজার নারীর জীবন বদলে দিয়েছেন- সাবিরা নীলা

0
উদ্যোক্তা- সাবিরা সুলতানা নীলা

এসএসসি পাশ করে চাচাতো বোনের কাজ দেখতে গিয়েছিলেন নীলা। তার কাজ দেখে নীলাও কাজটা শিখতে চাইলেন। কিন্তু নীলার এই আবদার তার চাচির মোটেও পছন্দ হলো না। তিনি বলেন, ‘তুমি নিজে কেনো কাজ শেখো না?’ একথাটা প্রবলভাবে তাড়িত করে নীলাকে। যদিও চাচির কথাকে আশীর্বাদ হিসেবেই নিয়েছিলেন তিনি। এরপর মায়ের অনুপ্রেরণায় কাজ শেখা শুরু করলেন। প্রথম দিকে সেলাই ও পোশাকের ডিজাইন শেখেন সাবিরা সুলতানা নীলা।

‘১৯৯৫’ সালে তার স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে পাখা মেলতে শুরু করলো। তিনি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। এ বছরই তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ‘আলতা বুটিকস’ নামে আত্মপ্রকাশ করলো। রঙে রঙে উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন সাজালেন নীলা। মাত্র ২৫ হাজার টাকা নিয়ে শুরু হয়েছিলো তার এই উদ্যোগক। শুরুতেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পেলেও একটু একটু করে এগিয়ে চললেন। শুরুর দিকে বাচ্চাদের বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক বানাতেন নীলা। এভাবে বেশ কয়েক বছর চললো। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের তাগিদ অনুভব করলেন তিনি। ২০০১ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বিসিক থেকে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেন। কাপড়ের ফুল, কাপড়ের পুতুল, মোমের শো-পিস, ব্লক-বাটিকের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে উঠলেন উদ্যোক্তা নীলা।

প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে আত্মবিশ্বাসী নীলা নিজের জীবনের নতুন দুটি লক্ষ স্থির করলেন। অন্যদের শেখাবেন এবং পণ্য তৈরি করবেন। ২০০৩ সালে পুরোদস্তুর প্রশিক্ষক হয়ে উঠলেন তিনি। শুরু করলেন তরুণ-তরুণী ও নারী-পুরুষদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একেকজন হয়ে উঠতে থাকলেন দক্ষ কর্মী। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পণ্য উৎপাদনের কাজ একসাথে চলতে লাগলো। দেখতে দেখতে দক্ষ কর্মী ও নান্দনিক পণ্যের এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন। হয়ে উঠলেন একজন সম্ভাবনাময় এমএমই উদ্যোক্তা।

২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সনামধন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মূলক সংস্থার সাথে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলেন নীলা। সেখানেও নিবিড়ভাবে কাজ করলেন অত্যন্ত সুনামের সাথে। একজন উদ্যোক্তা ও প্রশিক্ষক হয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন উদ্যোক্তা নীলা। এরপর নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন সাভার গিয়ে ফুড ও ব্লক-বাটিকের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসতে থাকেন। কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শক্ত মনোবল তৈরি করলেন। প্রশিক্ষণ ও পণ্য তৈরির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে সার্থকতা মিলতে থাকে। এগিয়ে চলেন সফলতার পথে।

২০০৯ সালে সম্পূর্ণ বানিজ্যিক ভাবে ফুল উৎপাদন শুরু করেন উদ্যোক্তা সাবিরা নীলা। এরপর সিরামিক ফ্লাওয়ার ভাস উৎপাদন শুরু করলে ব্যাপক সাড়া পেলেন। প্রশিক্ষণ ও পণ্য উৎপাদন দুদিক থেকেই সফলতা মিলতে শুরু করলো। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে শতশত নারীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। এছাড়া গ্রাম পর্যায়ে কর্ম সক্ষমতা তৈরির লক্ষ্যে ব্রাক ইইপিতে তিন হাজারের মতো নারীকে প্রশিক্ষণ দিলেন। পিছিয়ে পড়া নারীরা নীলার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন।

২০১৩ সালে কাজে স্বীকৃতি স্বরূপ লাভ করলেন জাতীয় যুব পুরস্কার। জীবনের মোড় ঘুরে গেলো। বদলে গেলো জীবনের দর্শন। সে বছরই জয়িতা হিসেবে পুরষ্কার অর্জন করলেন। এছাড়া আরও অনেক সম্মাননা ও সাধুবাদ জমা হলো উদ্যোক্তা নীলার ঝুলিতে।

২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের কারাবন্দীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব পেলেন উদ্যোক্তা এবং প্রশিক্ষক সাবিরা নীলা। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের প্রশিক্ষণ দিতে বদ্ধপরিকর নীলা। নারায়নগঞ্জের অক্টো অফিস পিলখানায় হরিজন সিটি কলোনিতে ১৮ জন নারীকে নিয়মিত পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। নিবিড় কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীরা শিখছেন কাপড়ের ফুল ও পাতা তৈরির কাজ। পণ্য তৈরির পাশাপাশি ব্যাবসাটাও শিখিয়ে দিচ্ছেন তিনি। কিভাবে পণ্য বিক্রি হবে, কতটুকু লাভ করে বিক্রি করতে হবে সবই শিখিয়ে দিচ্ছেন তিনি। দলিত সম্প্রদায় ছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে সম্পৃক্ত করেছেন তিনি। এপর্যন্ত ১২ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।

দেশের প্রায় সব জেলাতেই উদ্যোক্তার পণ্য বিক্রি হচ্ছে। থাই ক্লে শো-পিস, সিরামিকস এন্ড নেট ফ্লাওয়ার, হোমডেকর ফ্লাওয়ার, উৎসব ভিত্তিক ব্লকের শাড়ি ছাড়াও নানান উৎসবে বাহারি ডিজাইনের পাঞ্জাবি ও শাড়ি সরবরাহ করে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা নীলা। একে একে ডানা মেলতে থাকে অসংখ্য উদ্যোগ। যোগ হয় শো-রুম ডেকর এবং স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরির কাজ। ‘খাবার বাড়ি’ নামে উদ্যোক্তার ফুড এন্ড ক্যাটারিং-এর নতুন উদ্যোগ সাড়া ফেললো। অর্ডার আসতে থাকলো বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসের লাঞ্চ ও স্নাকস আইটেমের। করোনা মহামারীর সময়েও বেশে শক্ত অবস্থানে ছিলেন উদ্যোক্তা নীলা।

প্রচন্ড পরিশ্রমী উদ্যোক্তা সাবিরা নীলা ফ্যাক্টরি, অফিস, প্রশিক্ষণ সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৮ ঘন্টা কাজ করেন। এমনকি তিনি তার পরের প্রজন্মকেও এ শিল্পে উৎসাহিত করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘ব্যাবসা করার জন্য মূলধন থাকাটাই যথেষ্ট নয়। প্রথমে যে পণ্য নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে সেটা সম্পর্কে ভালো ভাবে জানতে ও শিখতে হবে। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকলে সামান্য পুঁজি বিনিয়োগ করেও লাভবান হওয়া যায়’। আজ শীতলক্ষ্যার পাড়ে উদ্যোক্তাদের বাতিঘর হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা নীলা। অসংখ্য মানুষকে কাজে উদ্দীপ্ত করে আগামীর বাংলাদেশ গড়ায় এসএমইর ভূমিকাকে জানান দিয়েছেন তিনি। তার এই প্রচেষ্টা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের কল্যাণে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here