উদ্যোক্তা- শিবানী

‘কী করলে একজন মেয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে, সেই ভাবনাটাই ঘুরত মাথায়। একটু বড় হয়ে বুঝতে পারলাম সামাজিক অবস্থানের পাশাপাশি আর্থিক দিকেও একটা মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। তখন নিজের স্বামীর প্রতি, পরিবারের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। নিজের কথাটা বলার সাহস তৈরি হবে’। কথাগুলো বলছিলেন উদ্যোক্তা শিবানী।

পদবি ব্যবহার করেন না তিনি। নামেই তাঁর পরিচয়। শুধুই কি নাম? কাজই তো তাকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের দুয়ারে। সম্প্রতি ‘Entrepreneur of India’র খেতাব পেলেন তিনি। তবে লড়াই তো সবে শুরু। এই স্বীকৃতি তার লড়াইকে কুর্নিশ জানাল বটে, কিন্তু আসল লড়াই অন্য। নারীর স্বাবলম্বী হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই।

উত্তরপ্রদেশের জালাউন জেলার ছোটো একটি শহর কঞ্চ থেকে উঠে আসা শিবানীর বাবাও একজন সমাজকর্মী।

এই জালাউন থেকেই উঠে এসেছিল ফুলন দেবী। ‘ব্যান্ডিট কুইন’-এর প্রসঙ্গ তুলতেই হেসে ফেলেন শিবানী। নিজেও যে পিস্তল চালাতে পারেন! হাসতে হাসতেই জানালেন, সেসবের এখন দরকার পড়ে না। কারণ যে কাজ তিনি করছেন, সেটায় সফল হতে গেলে সমাজের মানসিকতার বদল আনতে হবে। স্রেফ একটা পিস্তল তা পারবে না।

“কিন্তু ভারতে একটা গ্রামের মেয়ে, আজও তাঁর স্বামীর প্রতি, পরিবারের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। নিজের খাওয়া-থাকার জন্য তাঁরা যা বলে, তা-ই শুনতে বাধ্য হয় ওই মেয়েরা। নয়ত তাঁদের যাওয়ার জায়গা থাকবে না।” কথাগুলো বলার সময় অদ্ভুত এক দৃঢ়তা, কষ্ট উঠে আসছিল উদ্যোক্তা শিবানীর গলায়।

আধুনিক ভারতে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো যে কতটা সত্যি, সেটা উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন। নিজের এলাকায় তো বটেই, কাজের সূত্রে যেখানেই গেছেন, একই ছবি উঠে এসেছে।

বাবার এনজিও-এর সূত্রে গ্রামের মেয়েদের পড়াশোনার কাজ চলছিল। তাতে অংশ নিয়েছিলেন শিবানীও। কিন্তু শুধু শিক্ষাই কি সব দিতে পারবে এদের? পড়াশোনার পাশাপাশি, মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাও তো জরুরি। না হলে তো সেই জোর পাবে না তাঁরা।

দিনের শেষে ঘরের সেই কোণাতেই তাঁদের ঠেলে দেবে সমাজ। সেই ৬ বছর বয়সের পথ নাটিকার অভিজ্ঞতা শিবানীকে এসব ভাবিয়েছে। বলা ভালো, বাধ্য করেছে ভাবতে।

ঝাঁ-চকচকে শহরে বসে, আমরাও কি বুঝতে পারি না সেসব? বিয়ের পর ‘ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব’ নেওয়ার অঙ্গীকার আজও একটি ছেলেই করে। মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার কোনও মন্ত্র নেই পুঁথিগুলোয়? সমাজ, পরিবার, স্বামী যা বলবে, ‘যো হুজুর’ বলে সেটাই শুনতে হবে, এমনই কি ভবিতব্য? প্রশ্ন তোলেন উদ্যোক্তা শিবানী।

এই একই প্রশ্ন তোলে শিবানীর সংস্থা “কাতরান”-ও। গ্রামের মেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন হ্যান্ডিক্রাফটের জিনিস তৈরি করে সংস্থাটি। সেখানে যেমন আছে পুতুল, তেমনই আছে ঘর সাজানোর জিনিস, ডায়েরি, আরও অনেক কিছু। আর এই সমস্ত কিছু তৈরি করা হয় ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে। ফেলে দেওয়া কাগজ, কাপড়, এমনকি ঘুঁটেও ব্যবহার করা হয়। আর এগুলো দিয়েই হয় মিরাকল। “কাতরান” শব্দটিই যেন আজ শিবানীর যাবতীয় শক্তির উৎস।

কথায় কথায় উদ্যোক্তা জানালেন তার নিজের জায়গা বুন্দেল খণ্ডের কথাও। অনেক চাষি, মজদুরদের বসবাস আশপাশের গ্রামগুলোতে। প্রতি বছর চাষের কাজে ক্ষতি হয়। লোকসান হয় মানুষগুলোর। তাই ক্ষেত ছেড়ে, ভারতের অন্যান্য জায়গায় তারা চলে যায় কাজ খোঁজার জন্য। কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না। এই জায়গা দাঁড়িয়ে সেই মহিলাদের রোজগার করা, স্বাবলম্বী হওয়া যে কতটা জরুরি, বুঝতে পারেন শিবানী। শুধু সেটাই নয়, এই ধারণা ছড়িয়েও দেন সব জায়গায়। এই রকমই ৩০ জন মহিলা আজ “কাতরান”-এর সর্বক্ষণের কর্মী। নিজেরাই কাজ করছেন, উপার্জন করছেন। সসম্মানে বেঁচে আছেন সমাজে।

কাতরানের স্টোর এখন একটিই, লখনৌতে। তবে শুধু মাত্র স্টোর-নির্ভর বিক্রিতেই সীমাবদ্ধ নয় শিবানীর বিপণন। অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে তাঁদের কাজ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতে। এই মহিলারা যাতে তাঁর ওপর বেশি নির্ভর না হয়ে পড়ে, সেই চেষ্টাও সবসময় করছেন শিবানী। স্বনির্ভরের আসল মানেটা প্রতিটা মুহূর্তে তাঁদের বোঝাচ্ছেন তিনি। কারোর ভরসায় না থেকে, নিজেই যাতে নিজের মতো করে কাজ শুরু করতে পারে, সেই ট্রেনিংও দেওয়া হয় তাঁদের।

নতুন করে আরও ৩০০ জন মহিলাকে Entrepreneur করার চেষ্টায় রয়েছেন উদ্যোক্তা শিবানী। এভাবে ধীরে ধীরে সারা ভারত জুড়েই মেয়েরা স্বনির্ভর হোক, এগিয়ে আসুক নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে।

উদ্যোক্তা শিবানীর চাওয়া, স্রেফ টাকা রোজগার নয়, এই মেয়েরাও যেন এক একজন শিবানী হয়ে ওঠে নিজের নিজের জায়গায়। তিনি শুধু পথটা দেখিয়ে দিতে চান, যাতে কারোর সেখানে চলতে সমস্যা না হয়। আজ তিনি “Entrepreneur of India” হয়েছেন। কাল যাতে এই মেয়েরাও সেই সম্মান পায়, সেটাই তাঁর আশা। সেখানেই তাঁর স্বপ্নপূরণ। ততদিন লড়াই ফুরোবে না।

(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here