নওগাঁ জেলায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান

0

আম বাজারে আসার আগে উৎপাদনকারী, রপ্তানিকারক, বাজারজাতকারীসহ নওগাঁ জেলার অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

রোববার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে নওগাঁ জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর আয়োজন করে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান।

কয়েক বছর ধরে নওগাঁয় ব্যাপক হারে আম উৎপাদন হলেও জেলায় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ছাড়া অন্য কোনো গবেষণা কেন্দ্র নেই। তাই জেলার আমের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে গবেষণা কেন্দ্র এবং প্রসেসিং হাউজ প্রয়োজন বলে সভায় উপস্থিত সংশ্লিষ্টরা মত দেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় এখন ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৫২৫ হেক্টর বেশি। প্রতি হেক্টর জমিতে সাড়ে ১২ মেট্রিক টন হিসেবে এবার ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৫ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার আংশিক বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত। একসময় এসব এলাকায় বৃষ্টিনির্ভর একটিমাত্র ফসল আমন ধান হতো। তবে এখন ধান ছেড়ে মানুষ আম বাগানে ঝুঁকছেন। এ এলাকার আম অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট। মে মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে আম পাড়া শুরু হবে।

সভায় জানানো হয়, আমকে কেন্দ্র করে মৌসুমে সাপাহার উপজেলা সদরে একটি বৃহৎ বাজার গড়ে ওঠে। সেখানে সড়কে দুইপাশে আমের আড়ৎ গড়ে ওঠায় যানজটে সৃষ্টি হয়। এছাড়া সকাল ও বিকেলে আম বিক্রি হয়। বিকেলে আম বিক্রি হলেও ব্যাংক বন্ধ থাকায় চাষিদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের নির্ধারিত সময়ের বাইরে অতিরিক্ত দুই ঘণ্টা খোলা রাখার প্রয়োজন বলে মনে করছেন। আমের পরিচর্যা শেষে আম পাড়ার সময় চাষিরা অর্থ সংকটে পড়েন। এক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে বেশি সুদে বাধ্য হয়ে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিতে হয়। পরিবহনে চাঁদাসহ বিভিন্ন স্থানে হয়রানি নিয়েও আলোচনা হয়।

নাকফজলি আমের জিআই সনদের দাবি জানিয়ে সাপাহার উপজেলার উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, এরইমধ্যে জেলাটি আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। জেলায় আমের গবেষণা কেন্দ্র দরকার। এবার আমের কী ধরনের পোকার আক্রমণ হয়েছে তা জানতে বিভিন্ন স্থানে দৌড়াতে হয়েছে। আমাদের আঞ্চলিক প্যাকেজিং হাউজ দরকার।

তিনি বলেন, ৪৫ কেজিতে আমের মণ ধরা হয়। ক্যারেট তিন কেজিসহ মোট ৪৮ কেজিতে মণ বিক্রি হয়। এই ওজন ঠিক করা দরকার। আম পাড়ার সময় অর্থ সংকটে পড়তে হয় চাষিদের। ব্যাংক থেকে ঋণ না পাওয়ায় ৩০-৪০ শতাংশ সুদে এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া গেলে চাষিদের জন্য সুবিধা হয়।

সোহেল রানা আরও বলেন, দুই বছর থেকে আম রপ্তানি হচ্ছে। কাগজে-কলমে ৭৭ মেট্রিক টন রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি রপ্তানি হয়েছে যা আমাদের অজানা। কোন রপ্তানিকারক কী পরিমাণ আম রপ্তানি করেছেন তা জানা দরকার।

আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী তৌফিক ফেরদৌস চাতক ও শাহাদাত হোসেন সজীব অংশ নেন। তারা বলেন, আমরা নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে আম রপ্তানিকে প্রাথমিকভাবে বেছে নিয়েছি। আমরা দেখেছি বাংলাদেশ সরকার ভারত এবং পাকিস্তানে আমাদের বিখ্যাত আম উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। যাতে বাইরের দেশে আমাদের আমের চাহিদা তৈরি হয় সেই উদ্যোগকে আমরা বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে এসেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই শিক্ষার্থী আরও বলেন, এরই মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ইউরোপীয় মার্কেটের আমদানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছি। ইউকে, ফ্রান্স এবং জার্মানির ইম্পোর্টারদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম আলোচনায় তা সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ আম উৎপাদন হয় তার খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ রপ্তানি হয়। বিদেশে বাংলাদেশি আমের এক বিরাট বাজার তৈরি হয়েছে। আশা করছি, নওগাঁর আমকে বিশ্ব বাজারে তুলে ধরতে আমাদের মতো আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন।

সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওলিউজ্জামান বলেন, আম নওগাঁর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আম চাষিদের মাঝে জেলায় এবছর এক কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের জন্য রপ্তানি বা প্রক্রিয়াজাতকরণেও সহযোগিতা করা হবে। ব্যবসায়ীদের সোনালী ব্যাংকে ডিজিটাল ই-ওয়ালেট ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেখানে ২৪ ঘণ্টায় লেনদেন সম্ভব। এতে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে ঝুঁকি-ঝামেলা বা কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় নিরাপদ আম উৎপাদন হবে। নিরাপদ আম শুধু রপ্তানির জন্য নয়, দেশের জন্যও হবে। গত বছর ৭৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছে। এবার ৪৫০ মেট্রিক টনের মতো রপ্তানির সম্ভাবনা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সে লক্ষ্যে কৃষকরা আম উৎপাদন করছেন। আম বাজারজাত এবং রপ্তানিতে চাষিদের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) গাজিউর রহমান বলেন, আম পাড়ার মৌসুমে সাপাহারে রাস্তার দুইপাশে আমের আড়ৎ গড়ে ওঠায় যানজটের সৃষ্টি হয়। ব্যবসা পরিচালনায় কোনো ধরনের সমস্যা যেন না হয় সেজন্য বিগত বছরগুলোতে সেখানে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছিল। এবারও হবে। যেখানে ৩০-৫০ জন পুলিশ তিন মাস থাকে। এছাড়া আমের মৌসুমে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো আম পরিবহনে বেশি চার্জ ধরে থাকে। সে বিষয়টি দেখা হবে। দেশের সব প্রান্তে জেলার আম পরিবহনে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে।

নওগাঁ জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, এবছর রপ্তানির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি হোক। আমের যে সম্ভাবনা তা আরও বাস্তবে রূপ নেবে। ব্যাপক প্রচারের জন্য সপ্তাহব্যাপী আম উৎসবের আয়োজন করা হবে। আম চাষিদের ঋণ পেতে যে সমস্যা তা সমাধানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় এসএমই ঋণ ও ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেওয়া হবে। এতে তাদের ঋণ পেতে সুবিধা হবে।

এছাড়া সবাইকে আম চাষের দিকে না ঝুঁকে আম প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্যাকেজিংসহ আম নিয়ে অন্যকিছুতে যাওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা, আম চাষি, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকসহ জেলার সংবাদকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

ডেস্ক রিপোর্ট,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here