কুমিল্লার তরুণ কিবরিয়া সরকার। ৮০’র দশকে ছোট্ট একটি ফ্যাক্টরি দিলেন ম্যানুয়াল কল উৎপাদনের। ১৯৯৭সালে, কাজী জসীম, গোলাম মোস্তফা, শাহাদাত হোসেন টিপু, কিবরিয়া কবির সরকার, মোঃ বদিউল আলম এই ৫ তরুণ মিলে ফ্যাক্টরিটি নিলেন এবং এই ৫তরুণ উদ্যোক্তা চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে একসাথে পথ চলা শুরু করলেন।
বংশাল থেকে যাত্রাবাড়ি নিয়ে গেলেন ছোট্ট ফ্যাক্টরিটি। কাঁচামাল হিসেবে পিতল ছিলো ৪৫ হাজার টাকা টন। সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন, সমান সংখ্যক পুঁজি নিয়ে তারা এগিয়ে যাবেন। ১৮টি ক্যাটাগরিতে পণ্য উৎপাদন করেন স্যানিটারি ফিটিংসের। সিদ্ধান্ত ভূল ছিলোনা। ভীষণ সাড়া মিললো প্রথম উৎপাদনেই। সফলতার মুখ দেখলেন উদ্যোক্তারা।
৭০ ভাগ স্যানিটারি ফিটিংস যেগুলো নজরকারা ছিলো, সেগুলো সব আসতো বিদেশ থেকে। বিদেশী ফিটিংসের রমরমা ব্যবসা চলতো। সেসময় চীন, জার্মানি, ইটালি এমন দেশ গুলো থেকে আসতো লাক্সারি ফিটিংস, স্যানিটারি ফিটিংসে যার চাহিদা ছিলো ব্যাপক। ভীষণ পরিশ্রম করে জাহাজ ঘাটা, শিপ ইয়ারে শিপ বেকিং ইয়ার থেকে পিতল কিনে নিয়ে আসতেন আসার সময় ট্রাকের ফ্রন্টের মাথায় ঘুমাতেন বদিউল আলম। পরিশ্রমটা হত এমনি । কিবরিয়া সরকার দেখতেন প্রোডাকশন। অন্যান্য সদস্যরা ভীষণ উৎসাহ দিতেন।
চট্টগ্রামের জুবিলি রোড কেন্দ্রীক যে ব্যবসা, সেখানেই প্রথম বড় সেলটি শুরু হয়। প্রথম থেকেই চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছিলো না। স্যানিটারি ফিটিংসের যতরকম ফিটিংস বাসা-বাড়িতে ব্যবহার হয়, সোপকেস, বেসিন কল, বেসিনের কলের সাথে পানি নিয়ন্ত্রণের কল, শাওয়ারের কল এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় যত ফিটিংস আছে সবগুলোর প্রোডাকশন শুরু হলো ফ্যাক্টরিতে। ভীষণ সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে শুরু করলেন উদ্যোক্তারা।
ফার্মগেট, মিরপুর, আলু বাজার, খিলগাঁ, ফকিরাপুল এবং অনেক ট্রেডারদের কাছে দিলেন তাদের পণ্য। পণ্য গেলো সিলেট মাধবদী। ইপিজেড ঢাকায় পণ্য দিলেন উদ্যোক্তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিলো উদ্যোক্তাদের পণ্য। বাজার সম্প্রসারণ হতে থাকলো। বাজার পেলেন পিডব্লিউডি। অর্ডার শিডিউল অব রেটস অন্তর্ভূক্ত হলো উদ্যোক্তাদের পণ্য। বুয়েট কর্তৃক পরীক্ষিত হলেন উদ্যোক্তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম সার্টিফাই করলো। ২০০০ সাল পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময় যখন ডিজাইনের পরিবর্তন আসতে থাকলো স্যানিটারি ফিটিংসে তার সাথে অতি দ্রুত অভিযোজন করলেন উদ্যোক্তারা তাদের পণ্যের।
বিদেশী কল এবং বিদেশী নানান ফিটিংস ঝকঝকে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশী পণ্যের ওয়ারেন্টি খুব আশানুরুপভাবে মিলতো না। নষ্ট হলে ফেলেই দিতে হতো পণ্যগুলো। সেখানে দেশীয় উৎপাদিত পণ্যে ৭ বছরের ওয়ারেন্টি। উদ্যোক্তাদের পণ্যের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে দিলো অনেকগুন। নিয়ে গেলো উদ্যোক্তাদের পণ্যের অবস্থান এক অনুন্ন উচ্চতায়।
ইপিজেড, কোরিয়া, বেপজা, নেভাল একাডেমি, চট্টগ্রাম পোর্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের ভবনসমূহ, রাজুকের ভবনেও অনেক পণ্যের অর্ডার পেলেন উদ্যোক্তাদের সরকার মেটালস ওয়ার্কসের ফিটিংস।
পোটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে মিললো ব্যাপক অর্ডার। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রকৌশল বিভাগে অফিশিয়াল সার্টিফিকেশন লেটার পৌঁছে দেয় সারা বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের পণ্য।
সরকারি মান নিয়ন্ত্রণে সকল মান উত্তীর্ণ করেছেন উদ্যোক্তারা। তাদের পণ্য কোয়ালিটি সার্টিফিকেশন অর্জন করেছে। আমেরিকান স্টান্ডার্ড টেস্টিং মেথড, ব্রিটিশ স্টান্ডার্ড মেথড এবং ইন্ডিয়ান স্টান্ডার্ড মেথডে আজ উদ্যোক্তারা শত পণ্য নিয়ে। চার কোয়ালিটির বাথটাব মিক্সার, মুভিং সিংক মিক্সার, ফিক্সড বেসিন মিক্সার, মুভিং সিংক কক, লেফট-রাইটে মুভিং ফিল্টার কক, টু ইন ওয়ান বিপ, স্টপ কক, স্পেশাল কন্সেল বিপ, সিংক বিপ কক, হেভি লং ফিল্টার কক, নর্মাল স্টপ ককসহ আজ পণ্যের ভুবনে ২৮ টি ক্যাটাগরিতে ১১০ টিরও বেশি স্যানিটারি ফিটিংসের পণ্য উৎপাদন করছেন উদ্যোক্তারা।
দেশের ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় বিশ্বমানের ফিটিংস পণ্যে যত দিক আছে, চাহিদা আছে সবকিছু মিলিয়ে বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন বাজারে। ৫ তরুণ উদ্যোক্তা মিলে তাদের পথ হাটা শুরু করেন এবং হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। গড়ে তুলেছেন এসএমই মাঝারি খাতে স্বনামখ্যাত স্বীয় উদ্যোগ, স্বীয় পণ্যের বাজার।
৩০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ইতিমধ্যেই উদ্যোক্তারা আজ ৪ হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্যাক্টরিতে ৮০ জনেরও বেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
অপু মাহফুজ