উদ্যোক্তা-ফারহানা ইয়াসমিন মুক্তা

৯৯৯ সাল থেকে বর্তমান ২০২০ সাল। আজ অবধি বসে থাকা হয়নি। স্কুলের শিক্ষকতা, প্রাইভেট টিউশনি, প্রাইভেট জব কোনো কিছুই বাদ রাখেননি৷ উপার্জনে মগ্ন সব সময়। ১৯৯৭ তে মেট্রিক পাশ করার পর টিউশনি করা শুরু করেন ফারহানা ইয়াসমিন মুক্তা। ১৯৯৯ তে এইচএসসি পাশ করার পর পরই নারায়নগঞ্জের একটি স্কুলে শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন।

২০০০ এ অনার্স এ ভর্তি হলেন সরকারী তিতুমীর কলেজের পলিটিক্যাল সাইন্স ডিপার্টমেন্ট এ। ২০০৫ এ বিয়ে হয়ে যায় মুক্তার। ২০০৬ এ ডাক্তার স্বামীর সাথে পাড়ি জমান সিরাজগঞ্জে স্বামীর কর্মস্থলে৷ সেখানে খাজা ইউনুস আলী ল্যাবরেটরি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এক বছর সেই স্কুলেই চাকরী করা হল। স্বামীর চাকরির সুবাদে ২০০৭ এ ঢাকা ফিরে আসা হল আবার৷ এবার একটা প্রাইভেট ফার্মে এক্সিকিউটিভ পদে চাকরিতে জয়েন করলেন। ৯টা-৫টা চাকরি। মা হিসেবে নিজে অনেক আপসেট থাকতেন মুক্তা সে সময়টা। তার বাচ্চার প্রপার টেক কেয়ার হচ্ছে না। তাই চাকরি ছেড়ে দিতে হল। কিন্তু ছেড়ে দেবার কয়েক মাস আগ থেকেই মুক্তার মাথায় চিন্তা আসতে লাগলো, চাকরি ছেড়ে বাসায় কি করব? বাসায় বসে থাকতে হবে। কিন্তু বসে থাকার মানুষ তো আমি না।

মুক্তার গ্রামের বাড়ি আড়াইহাজার থানার পাঁচরুখি গ্রামে, যা বাটিক শিল্পের জন্য সমৃদ্ধ। এলাকা যেহেতু এ কাজের জন্য প্রসিদ্ধ, মুক্তা ভাবলেন এলাকার পরিচিতির কারণে কর্মী যোগাতে সুবিধা হবে, নিজের গ্রাম থেকে সুবিধা পাবেন, এলাকার পরিচিতি মানুষকে কাজে লাগাতে পারবেন- তাই এমন কিছু করবেন যা গ্রামের জন্য উপযুক্ত হবে।

মুক্তা ভেবেছিলেন একটা বুটিক শপ দিব। ব্যবসায়ী হব। উদ্যোক্তা হবেন- এমনটা চিন্তাই করেননি।

ব্যবসার প্রথম মূলধন ৫০০০ টাকা। ১৭ টা থ্রি পিস কিনে আনলেন নারায়ণগঞ্জ গ্রামের বাজার থেকে। মুক্তা তখন থাকতেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। আশে পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীদের সাথে বেশ সখ্যতা ছিল মুক্তার। মুক্তার আনা ড্রেসগুলো দেখে সবাই খুব পছন্দ করল। ১৭ টা ড্রেসের ১০ টাই একেবারে বিক্রি হয়ে গেল।

মুক্তার মনে আশার সঞ্চার হল। যদি চাকরি ছাড়ি এভাবেই ব্যবসা করব। ড্রেস বিক্রির টাকা প্লাস লভ্যাংশ দিয়ে ছুটির দিনে নারায়ণগঞ্জ এ গিয়ে আরও কিছু ড্রেস কিনে নিয়ে আসলেন। চাকরি ছাড়ার আগের শেষ চার মাস এভাবেই চাকরি ও ব্যবসা চালিয়ে গেলেন। আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশী, তাদের আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে সফল বেচা-বিক্রি করতে থাকলেন।

এবার বাটিকের ব্যবসার সাথে ব্লক এড করতে চাইলেন। মুক্তা তার এক কাজিনের কাছ থেকে ব্লক করা শিখে নিলেন। ভোরবেলা বাবুরহাট যেতেন। সেখান থেকে গজ কাপড় কিনে নিউমার্কেট এ রওনা হতেন। নিজের ডিজাইন ও কালার কম্বিনেশনে ব্লক করিয়ে নিতেন। তার ডিজাইন করা থ্রি পিস লুফে নিতে থাকলো তার কাস্টমাররা।

এবার সময় হল চাকরি ছেড়ে দেবার। পুরোদস্তুর উদ্যোক্তা হবার পথে ফারহানা ইয়াসমিন মুক্তা। সময়টা ২০০৭ সাল। সে সময় ব্লকের ডিমান্ড ছিল প্রচুর। সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত নিউমার্কেট থেকে ড্রেস ব্লক করিয়ে সেলের জন্য রেডি করে আনাটা ছিল খুবই কষ্টের এবং সময়সাপেক্ষ। যে কারণে মুক্তা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, সে সময়ের মারপ্যাঁচে আবার পরে গেলেন। আবারও বাচ্চার টেক কেয়ার করা হচ্ছে না। এত ডিমান্ড থাকা সত্ত্বেও ব্লক বাদ দিতে হল। পুরোপুরি মনোনিবেশ করা হল বাটিকে। কাকডাকা ভোরে বাবুরহাট থেকে ঘুরে ঘুরে তাঁত আর বাটিকের ড্রেস কিনতেন। প্রচুর জানাশোনা হল। ২০১০ পর্যন্ত এভাবেই ব্যবসার চাকা ঘুরতে থাকলো। প্রতি সপ্তাহে মাল নিয়ে আসা, বসুন্ধরা আবাসিকের মত অভিজাত এলাকায় ভালো কিছু সার্কেলে পণ্য সেল ভালোই চলছিল।

২০১০।। স্বামীর পোস্টিং হল এবার সিলেটের কুলাউড়ায়৷ স্টকের প্রডাক্ট নিয়েই রওনা হলেন স্বামীর নতুন কর্মভুবন, নতুন ঠিকানায়।

নতুন জায়গা। নতুন পরিবেশ। নতুন মানুষ। একদম চেনা জানা নেই৷ কুলাউড়ার প্রাইভেট একটা স্কুলে সিভি ড্রপ করলেন। যেহেতু আগে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল, এক নিমিষেই চাকরি হয়ে গেল। কিন্তু সবসময় ভাবতেন নিজের ৩ ব্যবসাটাকে কিভাবে সচল করা যায়?

ব্যবসায়ী মুক্তার মাথায় একটাই চিন্তা আর মনে একটি শংকা ব্যবসাটা কি হবে? ৩ বছরের পরিশ্রম কি শেষ হয়ে যাবে এভাবে? স্কুলের চাকরির পাশাপাশি আবার টিউশনি করানো শুরু করলেন। সাথে করে যে ড্রেসগুলো নিয়ে গিয়েছিলেন সে সম্পর্কে স্কুলের কলিগদের জানালেন। স্বামী ডাঃ নাদিম, সে সময় কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার। স্বামীর ফিমেল কলিগদেরও বললেন, “আমার কিন্তু আরেকটা পেশা আছে, আমি একটা ব্যবসাও করি। চাকরির পাশাপাশি আমি এটা করি।

মুক্তার পরনের ড্রেস দেখে কেউ আগ্রহী হলে তাকে পণ্য দেখবার ও কেনার আমন্ত্রণ জানাতেন। এভাবে টুকটাক সেল হতে শুরু করলো আবার। সিলেট থেকে ছুটিতে নারায়ণগঞ্জে ফেরা হলে পোশাক কিনে নিয়ে যেতেন মুক্তা। ২ বছর এভাবেই কেটে গেলো।

বাচ্চাকে স্কুলে দিতে হবে। এ চিন্তা থেকেই ২০১২ এর শেষে স্কুলের চাকরি, টিউশনি সব ছেড়ে চলে এলেন নারায়ণগঞ্জে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন আর চাকরি না। শুধু ব্যবসা। নিজের উদ্যোগের ব্যবসাকে দাঁড় করাতেই হবে।

আবারো স্টকে পণ্য জমালেন। ২০১৩ সাল। বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করালেন। বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাবার সময় ড্রেসও সাথে করে নিয়ে যেতেন -গার্জিয়ানদের কাছে সেল করার জন্য।

সময়টা ছিল খুব কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের। অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যার স্বামী একজন ডাক্তার, যে নিজে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে, তাকে কেন ড্রেস সেল করতে হবে? – এসব কথায় মাথা ঘামাতেন না মুক্তা। নীরব হাসিই ছিল তার উত্তর।

ডাক্তার স্বামীর বন্ধুরা ছিল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। তাদের সাথে মুক্তা নিজের ব্যবসার কথা শেয়ার করলেন। বন্ধুদের মধ্যে একজন খুব ভালো বন্ধু ছিল ডাঃ রিনি। তিনি মুক্তার ব্যবসার গল্প শুনে কুরিয়ারে কিছু ড্রেস পাঠাতে বললেন। রিনি সেল করে দিবেন। ডাঃ রিনির কাছে বাটিকের ২০ টা ড্রেস পাঠালেন মুক্তা। যেদিন ড্রেসগুলো হাতে পেলেন রিনি, সেদিনই সব সেল হয়ে গেল। ফোনে এসব কথা শুনে নিজের কানকে যেন বিশ্বাস ই করতে পারছিলেন না। অবিশ্বাস্য লাগছিল সব।

২য় লটে মুক্তা ৫০ টি থ্রি পিস পাঠালেন। এবারও সব সেল। প্রায় ১ বছর চলতে থাকলো এভাবে। মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকার ড্রেস সেল করতে লাগলেন মুক্তা ও ডাঃ রিনি মিলে। এদিকে ডাঃ রিনি অস্ট্রেলিয়া চলে যাবেন। যাবার আগে মুক্তাকে পরামর্শ দিলেন অনলাইনে ব্যবসা চালাতে। যারা ময়মনসিংহ থেকে মুক্তার পণ্য কিনতো তাদেরকে ফেসবুকে এড করিয়ে দিয়ে গেলেন রিনি। রিনি চলে যাবার পর ফেসবুক প্রোফাইল আর বাচ্চার স্কুলেই সেল হতে লাগলো।

ইতিমধ্যে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী রানা কায়সার পরিবারের বন্ধু পেজ খুলে দিলেন। মুক্তা পেজের নাম দিলেন সাতরঙ। রানা পরামর্শ দিলেন শুধু প্রোফাইলে না, পেজে ব্যবসা করতে। ধীরে ধীরে সাতরঙ পেজে ট্রান্সফর্ম হতে থাকলো। প্রোফাইলের বন্ধুরা এক এক করে লাইক দিল পেজে। তারা ইনভাইট করে অন্যদের চেনাতে লাগলো। এবার চেনা কাস্টমার এর গণ্ডি পেরিয়ে অচেনা কাস্টমার এর আগমন। অল্প স্বল্প আননোন কাস্টমার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, বাচ্চার স্কুল আর ফেসবুক পেজ তিন মিলেই – সাতরঙ।

২০১৫ সাল।। সেল বাড়তে থাকলো হুহু করে। মুক্তার মনে হল এবার নিজেই প্রডাকশন করব। প্রোডাক্ট সোর্স করলে মনমত ডিজাইন ও কোয়ালিটির পণ্য পাওয়া যায় না। যাদের কাছ থেকে পণ্য কিনতেন, খুব সাহস করে একটা বড় অর্ডার দিলেন- ১০০ পিস ড্রেস নিজ ডিজাইনে। রেডি ড্রেসও কিনলেন কিছু। অর্ডার করা ড্রেস হাতে পাবার পর মন হল “এইতো আমি চাই।” এই পণ্যের সাড়া ছিল সবচেয়ে বেশি।

মুক্তা দৃঢ় সংকল্প নিলেন। পুরো প্রডাকশন নিজে করবেন৷ এজন্য চাই অনেক কাপড়। দুরুদুরু বুকে মিল মালিকদের সাথে যোগাযোগ করলেন। মিলে মিনিমাম অর্ডার ৫০০০ গজ। তা ই অর্ডার দিলেন। এলাকায় কারখানা ভাড়া নিলেন। ৫ জন সহকর্মী সাথে নিলেন। নিজ ডিজাইন, কালার কম্বিনেশনে নানান ধাপ অতিক্রম করে তৈরি হতে লাগলো থ্রি পিস।

টাইডাই কিংবা বাটিক পণ্য তৈরি করতে গেলে অনেক রিজেক্ট হয়, ডিফেক্ট হয়৷ থ্রি পিস হিসেবে যার ভ্যালু থাকে না। কিন্তু উদ্যোক্তা তো তিনি ই যিনি নতুন ভাবনার জন্ম দেন।

সেই ড্রেস/কাপড় থেকেই বেবী ড্রেস বানানোর চিন্তা করলেন। দরকার হস্ত শিল্প কর্মী। নিজ এলাকায় ঘুরে ঘুরে ৫ জন সেলাই কর্মী খুজলেন। ৩ জনের কাজ খুব ভালো লাগলো। তৈরি করা হল নানান ডিজাইনের বেবী ড্রেস, কুশন কাভার, হ্যান্ড ব্যাগ।

বর্তমানে নিয়মিত প্রোডাকশনে আছে থ্রি পিস, বিছানার চাদর, পর্দা, তাঁতের পোশাক, পাঞ্জাবী, হিজাব প্রভৃতি। থ্রি পিসের মাসিক প্রডাকশন ক্যাপাসিটি ৬-৭ হাজার পিস। উদ্যোক্তা ফারহানা ইয়াসমিন মুক্তা কর্মসংস্থান করেছেন প্রায় ২২ জন কর্মীর।

সম্প্রতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউকে এবং জাপানে গিয়েছে উদ্যোক্তার পণ্য। এক বছরে প্রায় ৫ লক্ষ টাকার পণ্য পাঠিয়েছেন উদ্যোক্তা তার বিদেশের বায়ারের কাছে।

শুধুমাত্র অনলাইনে (এফ কমার্স) ব্যবসা করে ব্যবসায়িক মূল্যমান দাঁড় করিয়েছেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার। প্রায় ৩০০ জন এনলিস্টেড ক্রেতা আছেন যারা হোলসেলের জন্য এবং নিজের জন্য পণ্য ক্রয় করেন মুক্তার কাছ থেকে।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here