রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে পাশ করলেন একজন তরুণী। পড়াশোনা শেষ করে আসবার পর তার ছোট মামার সাথে গল্প করতে বসলেন। মামা শাওন আকন্দ একজন গবেষক এবং শিল্পী। দুজনে মিলে উদ্যোগ শুরু করলেন। ৬৫ হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন তারা। বর্তমানে পরিচালনা করছেন প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা তরুণী শারমিন লাবনী এবং একজন শিল্পী, একজন গবেষক জনাব শাওন। যৌথ উদ্যোগে শুরু করেন তাদের ব্যবসা। নানী সৈয়দা মুসা একজন সমাজসেবী এবং লেখক। ৭০ দশকের কুষ্টিয়াতে খুলেছিলেন কো-অপারেটিভ সোসাইটি ২৫০ জন নারীকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এক পরিবারের রক্ত বইছে শাওনের শরীরে।
২০১৬ সাল থেকেই উদ্যোক্তা হবার পথে যাত্রা শুরু।শাওন আকন্দ এবং লাবনীর উদ্যোক্তা হবার পথে এগিয়ে চলা। শাওন আকন্দ’র পারিবারিক সূত্রে পাওয়া তার মা এবং নারীরা পারিবারিক এবং সামাজিক নারীদের নিয়ে কাজকর্ম আগে থেকেই করেছিলেন। তারাই সমাজের ঐতিহ্যবাহী নকশিকাথা এবং হস্তশিল্পের পরচিতি এগিয়ে নিবার পথে কাজ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও শারমিনের খুব একটা ধারণা ছিল না গ্রামীণ জনজীবন সম্পর্কে। বাউল গান আর গ্রামীন পরিবেশের সাথে মিশিয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা হয় গ্রামীণ লোকশিল্প সম্পর্কে। যা কিনা আধুনিকতার নামে বাঙালির সংস্কৃতি থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছিল। যখন তারা দুজনে উদ্যোগ শুরু করেছিলেন তখন ব্যাপারটা ছিল দুজনেই ভিন্ন ধরনের কিছু একটা করব। উদ্যোগ শুরু হলেও পুরোপুরি ব্যবসা হিসেবে উদ্যোগটি ছিলোনা। প্রথম পণ্য উৎপাদন হল নোটবুকে নকশিকাঁথায় কিংবা সুই সুতার ফুরনে কাজ করে এর কভারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নোটবুকেই মনে হয় ফুটিয়ে তুলেছে এক একটি গল্প। কোন নোটবুকে ছয় ঋতুর নকশা ফুটিয়ে তোলা, কোনটির কাভারে প্রাকৃতিক দৃশ্য, আবার কোনোটিতে পালকি চরে যাচ্ছে বউ, শাপলা-শালুক তুলছে গ্রাম্য কিশোরী, সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং, বর্ষার বৃষ্টি ভেজা কদম ফুল কিংবা শরতের কাশফুল, বাংলাদেশের জিআই পণ্য জামদানির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ, নকশী নোটবুক সিগনেচার প্রোডাক্ট হয় যথা শিল্পের।
উদ্যোক্তা বৃন্দ’র কাজ এগিয়ে যেতে থাকল। অভাবনীয়ভাবে ভাবে সেল রেসপন্স বাড়তে থাকলো। উদ্যোক্তাদের উদ্যোগের উৎসাহ দিন দিন বেড়ে যায়। এরপর আসে শতশত গামছার অর্ডার নিয়ে, উদ্যোক্তারা হন অনুপ্রাণিত। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর বর্ষপূর্তিতে শিল্পের নোটবুক উপহার যেন সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট ক্লায়েন্ট কিংবা খ্যাতিমান ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে যায় একটি নাম নিয়ে তা হলো “যথাশিল্প”। সকলের প্রশংসা আর সাধুবাদ তাদের অনুপ্রেরণা বাড়িয়ে দিলো আরো কয়েকগুণ বেশি। তাদের এই উদ্যোগে কাজ করতে থাকে গ্রামীণ নারী কামার-কুমার এবং কাজ করতে থাকেন কাগজ উৎপাদনকারী কর্মী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং সাপ্লাইয়াররা।
বাঙালির ঐতিহ্য, কালচার, ট্রাডিশন কিংবা বিভিন্ন দিবসকে সামনে রেখে তারা কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছেন। নিত্য নতুন পণ্যের কাজ করে আলোকিত করছে উদ্যোক্তার ভুবনকে। লোকোমোটিভ, গ্রামীণ ঐতিহ্য যেগুলো দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলো কে নতুনভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরাই তাদের লক্ষ্য। বিভিন্ন ধরনের নোটবুক যেনো কথা বলতে শুরু করে। বিভিন্ন ধরনের নোটবুক, দেশীয় ডিজাইনের টি-শার্ট, নান্দনিক জামদানী ডাইভারসিফাইড প্রডাক্টস,স্কার্ফ, হিজাব, গামছা শাড়ি,গামছা বিভিন্ন ধরনের টেরাকোটা,হান্ড প্রিন্টেড প্রোডাক্ট, মেটাল প্রোডাক্ট, রিকশা পেন্টিং সিনেমা ব্যানার, হোম ডেকর পণ্য বাশ, বেত ও বিভিন্ন শিল্প পণ্যের পরিচিতি হতে থাকে মানুষের কাছে, ক্রেতার কাছে, কাস্টমারদের কাছে।
বুক ওয়ান, বাতিঘর, ল্যাভেন্ডার, মিনাবাজার, কে ক্রাফট, পাঠক সমাবেশ বেঙ্গল বই, ইউনিমার্ট, আগোরার মত জায়ান্ট চেইনশপে, সুপারশপে অথবা আধুনিক যে কোন প্লেসে মিলতে থাকে যথা শিল্পের পণ্য। ব্যাপক সমাদৃত হতে থাকে উদ্যোক্তাদের পণ্য ক্রেতাদের মাঝে। উদ্যোক্তাদের আর ফিরে তাকাতে হয় না পেছনে।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকারের রাষ্ট্রীয় উপহার একটি সুবিশাল এবং একটি সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের একটি বাক্স যেন এনে দেয় উদ্যোক্তাদের স্বপ্নকে।
আজ উদ্যোক্তাদের ক্লায়েন্ট দেশের সব বড় বড় জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান। বড় বড় একেকটি অর্ডার উদ্যোক্তাদের নিয়ে গেছে স্বপ্নের উচ্চতার শিখরে । কলমদানি, টিস্যু বক্স, শখের হাঁড়ি, বিয়ের কার্ড, টেরাকোটা ওয়ার্ক, সকল কাস্টমাইজড পণ্যের কাজ, বাঁশ ও বেতের ঐতিহ্যবাহী সরপোশ, চাল মাপার কাঠা ও বেতের ফুড বাস্কেট, স্পুন হোল্ডার, শত শত নিত্য নতুন পণ্যে আজ আলোকিত উদ্যোগক্তাদের ভুবন।
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশি কাস্টমার আজ উদ্যোক্তাদের ক্লায়েন্ট লিস্টে। বিভিন্ন দেশের বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদূতরা আসেন উদ্যোক্তার এই ভুবনে। তাদের কাজটি বাংলাদেশকে নিয়ে। একটা ছোট্ট টেপা পুতুল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানের সিলেটের শীতল পাটি, কিংবা জামদানি স্কার্ফ, কিংবা মুখোশ, হতে পারে একটি টি-শার্ট, কটি, কামিজ, পাঞ্জাবি কিংবা শাড়ি। মাত্র পাঁচ বছরে অর্জন করে ফেলেছেন শক্ত অবস্থান এবং নিজেদের উদ্যোগকে রূপ দিয়েছেন কোটি টাকা মূল্যমানের একটি উদ্যোগে।
মার্জিয়া মৌ,
উদ্যোক্তা বার্তা