চা শ্রমিকদের ‘মুল্লুকে চলো’ দিবস আজ

0

২০ মে ‘ঐতিহাসিক চা শ্রমিক দিবস’ হিসেবে সারাদেশের চা বাগানে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। চা শ্রমিকদের কাছে দিনটি একদিকে যেমন খুবই তাৎপর্যময় ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত; তেমনই অনেক বেশি আবেগ ও প্রেরণার উৎস। চা বাগানে ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে মজুরি, শিক্ষাসহ সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে কিছুটা প্রাপ্তি এবং স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে। তাই ‘ঐতিহাসিক মুল্লুক চলো’ দিবস চা শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষার ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণা জোগাবে।

ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১৮৩৪-১৮৩৫ সালে চা শ্রমিকরা ব্রিটিশ চা বাগান মালিক দ্বারা অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ১৯২১ সালের এই দিনে নিজ মুল্লুকে (আবাসভূমিতে) ফিরে যাওয়ার জন্য ‘মুল্লুকে চলো আন্দোলন’ করেছিলেন। তারা হেঁটেই সিলেট থেকে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাট পর্যন্ত আসেন। এখানে ব্রিটিশরা তাদের বাধা দেয়। বাধা অতিক্রম করে চা শ্রমিকরা মেঘনা নদী পার হয়ে নিজের মুল্লুকে যেতে চাইলে ব্রিটিশ গোর্খা বাহিনী তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। তারা হাজার হাজার চা শ্রমিকের পেট কেটে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। চা শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয় মেঘনা নদীর পানি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা বাগান তৈরি শুরু করে। সুন্দর ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে কোম্পানিগুলো দালালের মাধ্যমে দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্যপ্রদেশের অভাবপীড়িত ও অনুর্বর অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে আসে। তাদের আসাম ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গহীন জঙ্গলে চা বাগান তৈরির অমানসিক কাজে বাধ্য করা হয়। কিন্তু এক বেলাও পেট পুরে খাবার জুটতো না এসব শ্রমিকের। পাশাপাশি চলতো নানা শারীরিক নির্যাতন। সব মিলিয়ে অচিরেই তাদের সুন্দর জীবনের মোহ কেটে যায়।

ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এ আন্দোলনের কিছুটা বাতাস পান চা শ্রমিকরাও। ক্ষুধা, রোগ, জরা, মৃত্যু, নিজ আপনজন থেকে দূরে থাকা এবং আদৌ ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা তাদের বিদ্রোহী করে তোলে। ১৯২০ সালের বিভিন্ন সময়ে করিমগঞ্জ, ধলই, কাছাড় ভ্যালি, ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি ও সিলেট ভ্যালির বিভিন্ন চা বাগানে অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। ফলে ১৯২১ সালের মে মাসে চা শ্রমিকরা মুল্লুকে চলো বা নিজ জন্মস্থানে যাত্রার ব্যাপারে মন স্থির করেন। কিন্তু নির্দয় বাগানমালিকের সঙ্গে যোগসাজশে ব্রিটিশ সরকার রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আর কোনো উপায় না দেখে মে মাসের ৩ তারিখ ৩০ হাজারের বেশি চা শ্রমিক রেললাইন ধরেই চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করে।

তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পণ্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পণ্ডিত দেওসরন এ ‘মুল্লুকে চল’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। চা শ্রমিকদের কেবল ধারণা ছিল, স্টিমারযোগে কলকাতা যাওয়া যায়। এদিকে ২০ মে চা শ্রমিকরা মেঘনা ঘাটে পৌঁছালে আসাম রাইফেলসের গোর্খা সৈন্য মোতায়েন করে। পরিশ্রান্ত ও সংক্ষুব্ধ চা শ্রমিকদের নিবৃত্ত করে ফেরানোর জন্য তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি কমিশনার কেসি দের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে গোর্খা সৈন্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। অসহায় চা শ্রমিকের রক্তে লাল হয় মেঘনা নদীর জল। চা বাগানের ব্রিটিশ মালিক এবং তাদের দোসরদের গুলিতে এ দিন প্রাণ হারান কয়েকশ চা শ্রমিক। কারো কারো মতে, এ সংখ্যা কয়েক হাজার। অজস্র মৃতদেহ ভেসে যায় মেঘনার বুকে। যার মাধ্যমে সংঘটিত হয় ইতিহাসের নির্মমতম শ্রমিক হত্যাযজ্ঞ। এ বর্বরোচিত হত্যার পর স্টিমার শ্রমিক, রেলশ্রমিক এবং পুরো আসাম ও পূর্ববাংলার চা শ্রমিকরা একযোগে ধর্মঘট শুরু করে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসুর মতো নেতারা ছুটে আসেন চাঁদপুরে।

কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, চা শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা তাদের কিছু অধিকার অর্জন করলেও সব দিক থেকে শ্রমিকরা তাদের অধিকার পুরোপুরি অর্জন করতে পারেননি। ২০ মে মুল্লুক চলো দিবস ঘটা করে পালন হলেও শ্রমিকরা আজও অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার। এখনো থামেনি শ্রমিক নিপীড়ন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়নি চা শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রমের মূল্য। আজ ২০ মে ঐতিহাসিক মুল্লুক চলো দিবস চা শ্রমিকদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম বা লড়াইয়ে প্রেরণা জোগায়। এটি চা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ দিবসের অর্থ চা শ্রমিকদের রক্তাক্তের দিন, জাগরণের দিন, সংগ্রামের ঐক্য ও গভীর প্রেরণা।

ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here