চার উদ্যোক্তার ‘সাত মিজেল্লি’

0

দেশের পাহাড় ও প্রকৃতির সঙ্গে আদিবাসীদের জীবন যেভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, তা এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে প্রাচুর্যেরই প্রমাণ। তাদের খাবার, সংস্কৃতি, পোশাক, ভাষা সবকিছুতেই রয়েছে ভিন্নতা। তাদের সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ কমবেশি সবারই আছে। বিশেষ করে তাদের খাবারের প্রতি আকর্ষণটা একটু বেশি।

বর্তমানে তাই শহরের অভিজাত রেস্টুরেন্টের খাবারের তালিকায় চোখে পড়ে বিভিন্ন আদিবাসীদের খাবারের নাম। স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয় এসব বিচিত্র খাবার সহজেই সকলের মন-প্রাণ কেড়ে নেয়। এসব খাবার স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক উপকারী। বড় রেস্টুরেন্টগুলোর পাশাপাশি আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী খাবার অন্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন চার উদ্যোক্তা: বিপাশা চাকমা, সুইটি চাকমা, পিংকি মারমা এবং ইমেজ তালুকদার।

তাদের উদ্যোগের নাম ‘সাত মিজেল্লি’। বিপাশা, সুইটি চাকমা এবং ইমেজ খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা উপজেলা এবং পিংকি বান্দরবান জেলায় বেড়ে উঠেছেন।

শুরুর গল্প নিয়ে বিপাশা চাকমা বলেন, ‘এই খাবার নিয়ে কাজ করার ভাবনাটা মাথায় আসে মূলত ২০১৭ সালে। ছোটবেলা থেকে আমার রান্নার প্রতি একটা আগ্রহ ছিল। বাসায় আমি মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতাম এবং দেখতাম মা কীভাবে রান্না করছেন। কোন খাবারে কী পরিমাণ মসলা সামগ্রী দিচ্ছেন। কতটুকু এবং গুরুত্বপূর্ণ কী উপাদান ব্যবহার করেন। এভাবে আমিও রান্না করতে শুরু করলাম। রান্নাটা যখন পুরোপুরিভাবে মোটামুটি শিখে গেলাম তখন বন্ধুদের রান্না করে খাওয়াতে লাগলাম। তারা খুব প্রশংসা করতো।’

এভাবে তার হাতেখড়ি এবং পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খাবারের উদ্যোগ নেওয়া।

মায়ের অনুপ্রেরণা থেকে নিজেকে একজন আদর্শ উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন: আমার মায়ের হাতের রান্না খুব প্রশংসনীয়। যদিও সবার মায়ের হাতের রান্নাই অনেক মজার হয়; কিন্তু আমার মায়ের রান্নার মধ্যে অন্যরকম স্বাদ পায় সবাই। ২০২০ সালে বাংলাদেশে যখন করোনার সময় চলছিল, আমরা ঢাকা ছেড়ে সবাই বাড়ি চলে যাই। তখন ইমেজ দাদার সঙ্গে কথা হয়। শুরুতে আমি, সুইটি এবং ইমেজ দাদা তিনজন মিলে একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলি। প্ল্যান করি যে আমরা ঢাকা ফিরে ক্যাটারিং সার্ভিস দিবো। এখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। করোনা যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে তখন ২০২১ এর জানুয়ারিতে আমরা ঢাকা চলে আসি। ঢাকা এসে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। আসলে আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে তিনজন কী নিয়ে ব্যবসা করবো? এভাবেই দুই মাস চলে যায়। তারপর মার্চের শুরুতে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করা শুরু করি। ওখানে সাত মাস কর্মরত ছিলাম। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাতে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়।

সুইটি আর বিপাশার পরিচয় ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। তখন থেকেই তারা ভালো বন্ধু। তারপর পিংকির সাথে পরিচয় হয় ২০২১ সালে। এ তিনজন আর উদ্যোক্তা ইমেজ তালুকদার কথা বলে ‘সাত মিজেল্লি’র উদ্যোগ নেন। শুরু হয় তাদের যাত্রা।

ইমেজ তালুকদার বলেন: ছবি আপলোড দেওয়ার পরপর দেখি অনেকে খাবার অর্ডার করছেন। কিন্তু আমরা তখনও প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের পেজে এতো বেশি শেয়ার লাইক হতে থাকবে এবং অর্ডার আসতে থাকবে তা আমরা আশা করিনি। তখন আমরা ফাইনালি সিদ্ধান্ত নিলাম এবার বোধহয় সময় এসেছে যুদ্ধে নামার। আমাদের প্রথম কাস্টমার ছিলেন বান্দরবানের একজন। তিনি একবার অর্ডারের পর আরও অনেকবার অর্ডার করেন এবং উনার বন্ধুবান্ধবদের আমাদের পেইজকে সাজেস্ট করেন। এভাবে আরও অনেক অর্ডার আসতে থাকে এবং আমাদের মনোবল বাড়তে থাকে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন আমাদের কমেন্টে এবং মেসেজে উৎসাহ দিতে থাকেন এবং আমরা খুব উৎসাহিত হই, কাজের আগ্রহ বাড়ে। ‘সাত মিজেল্লি’নিয়ে সাড়া পেয়ে ৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে চাকমা, মারমা এবং রাখাইন খাবার নিয়ে শুরু করি।

চাকমাদের খাবারের এর মধ্যে রয়েছে পাজন, বাচ্ছুরি মালা/বাঁশ কোরাল মালা, সুমো গোরাং/বাঁশের ভেতরে মাছ বা মাংস বা ডিম রান্না, যেকোন মাছ বা মাংস হেবাং যেটাকে বাংলায় পাথুরি বলা হয়। মজাদার অনেক ধরনের পিঠাসহ নানা পাহাড়ি স্টাইলে রান্না খাবার আছে। সাথে রয়েছে রাখাইন এবং মারমাদের জনপ্রিয় স্পেশাল মুন্ডি, লাকসো ইত্যাদি।

খাবার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন তারা। পরে আইপি নিউজ আয়োজিত আদিবাসী ফুড ফেস্টিভ্যাল এবং চারুকলা আয়োজিত শরৎ মেলায় অংশ নেন। সেখানেও তারা কাস্টমারদের খুব ভালো রিভিউ পান। বর্তমানে ঢাকার ভেতর মোটামুটি সব জায়গায় ডেলিভারি দিচ্ছেন। এছাড়াও ঢাকার বাইরে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করছেন।

উদ্যোক্তা পিংকি বলেন, ‘‘যেহেতু আমরা তিন পার্বত্য জেলার আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী খাবার নিয়ে কাজ শুরু করি, সেখান থেকেই ‘সাত মিজেল্লি’ নামটা দেওয়া হয়। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য- আদিবাসীদের খাবার দেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে পরিচিতি করানো এবং এখান থেকে আয়ের অংশ দিয়ে অসহায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ‘সাত মিজেল্লি’ মানে অনেকগুলো খাবার একত্র বা একসাথ করাকে বুঝায়। তাই ‘সাত মিজেল্লি’ নাম দেয়া হয়েছে।”

ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে বলেন: শুধু খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন না। পাশাপাশি আদিবাসীদের পোশাক নিয়েও কাজ করবেন সামনে। কাস্টমারদের চাওয়া অনুযায়ী ভবিষ্যতে রেস্তোরাঁ করার পরিকল্পনা আছে চার উদ্যোক্তার। ‘সাত মিজেল্লি’কে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকবে সবসময়।। তারা স্বপ্ন দেখেন সব শহরে প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে থাকবে একটা করে ‘সাত মিজেল্লি’।

মেহনাজ খান,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here