নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় থেকেই সাইন বোর্ড, ব্যানার, স্কুল নেম প্লেট, ছবি বাঁধানো, দেয়ালে কিংবা গাড়িতে লিখে টাকা কামানোর শুরু জি এম নুরুল ইসলাম রনির। ১৯৯১ সালে ডিগ্রি পাশ করেন রনি। তারপর প্রায় ৩৫টির মতো চাকুরীর দরখাস্থ করলেন তিনি, চাকুরী হলো না।
জীবিকার সন্ধানে চলে গেলেন সৌদি আরব। সেখানে গিয়ে প্রচণ্ড কষ্ট করতে হয়েছে তাকে । কঠোর তাপমাত্রার মধ্যে কাজ করতে করতে ক্লান্ত অবিশ্রান্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বিদেশে আর এতো কষ্ট করা নয়। দেশে ফিরে আসলেন তিনি।
সৌদি থেকে আনা কিছু টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা জমি কিনলেন। বাড়ির কাজ করতেই টাকাটা শেষ হয়ে গেলো। স্ত্রী নূর জাহান ইসলাম ৫ হাজার টাকা নিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন। আবারো শুরু করলেন ব্যানার নির্মাণের কাজ সহ স্ক্রিন প্রিন্টিং এর কাজের মতো আরো অনেক কাজ। সৌদি থেকে এনে স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন একটি ইনকিউবেটর। কিন্তু সেই মেশিন যেখানে রাখলেন সেখানে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো না। ঢাকায় এসে পারেন্ট স্টকের ডিম কিনতে ঘুরে বেড়ালেন, বিক্রেতারা ডিম দিতে অস্বীকার করায় স্ত্রীকে জানালেন ডিম দেয়া মুরগি পালা হোক। স্ত্রী নূর জাহান ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১২০টি ডিম থেকে ১০৫টি বাচ্চা ফুটলো। একটি ঘটনা তাকে একটি এগ্রো ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্বপ্ন এনে দেয়। ১৯৯৯ সাল, ২ হাজার ৫’শ বাচ্চা ফোটানোর ইনকিউবেটর তৈরি করলেন রনি। উদ্যোগের অভাবনীয় সাড়া মিললো। ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে বানালেন প্রথম মেশিন। কুমিল্লার মোঃ আলী হিরো মেশিনটি কিনলেন। ১ লক্ষ টাকা যুবক রনির স্বপ্নকে এগিয়ে দেয়। চতুরদিকে লোকজন জেনে যায় বাংলাদেশে প্রথম পোল্ট্রির বাচ্চা ফোটানোর মেশিন তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানে বিগত ১০ বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকার মেশিন বিক্রি করেছেন উদ্যোক্তা রনি।
উদ্যোক্তা শুধু মাত্র মেশিন বিক্রয় নয়, বরং যে কোনো সার্ভিসের জন্য ২৪ ঘন্টাই খোলা রাখলেন। এবার নুরুল ইসলাম রনি ২০১০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিধি মোতাবেক টেন্ডারের মাধ্যমে সরকারীভাবে ৮টি জেলায় ৯০ হাজার ক্যাপাসিটির ৮টি মেশিন সেট করলেন। ২ কোটি টাকার কাজ সম্পূর্ণ করা হলো। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে, সবাই ভীষণ বিশ্বাস খুঁজে পেলো। বাংলাদেশের সকলেই জেনে গেলো দেশে উৎপাদিত পোল্ট্রি ইনকিউবেটর মেশিনের কথা। ৭ শতাংশ মেশিন তৈরি করা শুরু করলেন উদ্যোক্তা নুরুল ইসলাম রনি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে ২০০’র বেশি ছোট বড় ইনকিউবেটর ‘রনি এগ্রো ইঞ্জিনিয়ারিং’ থেকে বিক্রি করেছেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অর্ডার ভিত্তিতে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছে। পুরষ্কার মিলেছে অনেক। মিলেছে জাতীয় পর্যায়ে অনেক সাধুবাদ। কঠোর পরিশ্রমী এবং আত্মবিশ্বাসী উদ্যোক্তা এগিয়ে গিয়েছেন দুর্বার গতিতে তার আপন কর্মে। প্লাস্টিক হেজিং ট্রে, সেটিং ট্রে, নিজের ডিজাইনে পেটার্ন করিয়ে নিয়েছেন রনি, সারা বাংলাদেশে যার রয়েছে ভীষণ চাহিদা।
২০১৩ সালে ভারতে বেড়াতে যান রনি। একটি জায়গায় বেড়াতে গেলে, অনেক শিল্প এলাকা দেখলেন। চতুর্দিকের শুধু প্লাইউড ফ্যাক্টরি, ভীষণ আলোড়িত হলেন উদ্যোক্তা রনি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন,প্লাইউড ফ্যাক্টরি করতেই হবে। প্লাইউড ফ্যাক্টরির কাঁচামাল সব আসে বাইরের দেশ থেকে। এ খাতেও প্রচুর দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন রনি। ঠিক করলেন কাঁচামাল তৈরি হবে, সংগ্রহ হবে বাংলাদেশ থেকেই। গুজরাটে গিয়ে প্রথম মেশিনটি অর্ডার করলেন উদ্দ্যোক্তা। মেশিন আসলো, প্রথম দিন থেকেই বাণিজ্যিক ভাবে উদ্দ্যোক্তা উৎপাদন শুরু করলেন। প্লাটিনাম ডিসট্রিক্ট হিসেবে খ্যাত সাতক্ষিরায় যেখানে ৯০ হাজারেরও বেশি শুধু চিংড়ির ঘের, সেখানে জেগে উঠলো উদ্যোক্তার ক্ষুদ্র এবং মাঝারী উদ্যোগ । উদ্যোক্তা গাইলেন সফলতার জয়গান।
সুষম কর্ম অধিকারে বিশ্বাসী রনি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন , দিন রাত ২৪ ঘন্টার শিফটে নারী-পুরূষ উভয়কে নিয়েই কাজ করেছেন। সকলে মিলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উৎপাদন। মাত্র ৫ হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করা কঠোর আত্মবিশ্বাসী রনি আজ পরিনত হয়েছেন সফল উদ্যোক্তায়।