পড়াশোনা শেষ করার আগেই বিয়ে কিংবা মূলধন কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি উদ্যোক্তা ফারজানা ইয়াসমিন মুক্তার জীবনে। এইচএসসি এর পরই বিয়ে হয়ে যায় জনাব মোঃ বশিরুল আলম খান তপন এর সাথে তরুণ উদ্যোক্তা ফারজানা ইয়াসমিন মুক্তার। জনাব তপন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। বিয়ের পর থেকেই চার দেয়ালের মাঝে সারাদিন একা একা সময় কাটাতে হয় মুক্তার। বন্দী জীবনে মুক্তা উপলব্ধি করেন, জীবনে কিছু একটা করা দরকার। এতে করে নিজের সময়টাও যেমন ভালো কাটবে তেমনি সংসারেও আসবে স্বচ্ছলতা। কিছু একটা করতে হবে চিন্তাটা তখন থেকেই শুরু। মুক্তা ভাবেন, যেমন করেই হোক আমি নিজেই কিছু একটা করবো।
মুক্তা সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা করবেন । কিন্তু কিভাবে শুরু করবেন? ব্যবসার জন্য তো দরকার মূলধনের। মূলধন ছাড়া কিভাবে শুরু করবেন তিনি ব্যবসা? কি ব্যবসা করবেন, কিভাবে করবেন? স্বামী বশিরুল আলম খান তপন ভীষণ উৎসাহ দিলেন স্ত্রীকে উদ্যোক্তা হবার পথে এগিয়ে যেতে। এইসব নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন মুক্তা। যদিও স্বামীর সহযোগিতা এবং সাহস কোনো কিছুরই কমতি ছিল না। কিন্তু একজনের উপার্জনে সংসার চালানোই যেখানে কষ্টকর সেখানে ব্যবসার জন্য মূলধন, সে তো সোনার হরিণ! কিন্তু তাই বলে বসে থাকলে তো আর হবে না উপলব্ধি করলেন স্বামী তপন। ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকা লোন তুলে নিজের কাছে রাখলেন পাঁচ হাজার টাকা, আর স্ত্রীর হাতে দিলেন বাকি পাঁচ হাজার টাকা। শুধু পাঁচ হাজার টাকায় নয় স্ত্রীর পাশে থেকে করেছেন সহযোগিতা আর দিয়েছেন উৎসাহ এবং শ্রম। সেই সময় থেকেই উদ্যোক্তা হবার সংগ্রাম শুরু মুক্তার।
২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম জামালপুর থেকে ননদের মাধ্যমে পন্য কিনে আনেন মুক্তা, কঠিন আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ মনোবল নিয়ে। নিজেই করেন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ডিজাইন। অভিনব, নান্দনিক সব ডিজাইন আর কাপড়ের গুনগত মান ঠিক রেখেই শুরু করেন পথচলা। প্রথমেই এতটা সাড়া মিলবে মুক্তা কল্পনাও করেননি। নিজের কল্পনাকে হার মানিয়ে মাত্র কয়েক দিনেই পুঁজির টাকা উঠে আসে উদ্যোক্তার।
পণ্যের গুনাগুণ নিয়ে সবার মতামত এতটাই ইতিবাচক মনোভাব এনে দিলো যে, মুক্তা ঘরে বসেই নতুন আলোর সন্ধান পান। অনেক হতাশা দুশ্চিন্তার মাঝেও ঝলমলে আলো উকি দিয়ে যায় আধারের মেঘ ফুঁড়ে। ‘আমি পেরেছি, আমার ক্রেতারা আমার তৈরি পণ্য সন্তুষ্ট’ – এ চিন্তাটা মুক্তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহস আর তৃপ্তি দিচ্ছিলো।
এরপর থেকেই কঠিন সংগ্রাম শুরু মুক্তার জীবনে। নিউমার্কেট, বংশিবাজার, শেখেরটেক থেকে সংগ্রহ করেছেন কাঁচামাল। রাত দিন পরিশ্রম করে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইন করেছেন নিজেই। ঘরে সন্তান রেখে স্বামীর সহযোগিতায় জীবনের কঠিন সংগ্রাম পাড়ি দিয়েছেন মুক্তা। সঠিক সময়ে, সঠিক মানে, সঠিক মূল্যে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পৌছে দেওয়ার এই গুণগুলি উদ্যোক্তা মুক্তার স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যায় বহুদূর। উদ্যোক্তা মুক্তা নতুন চমক দিয়ে একটি নতুন ভূবন সাজিয়েছেন।
লক ডাউনের পুরো সময়টি উদ্যোক্তা হিসেবে টিকে থাকার সকল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন মুক্তা। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে একজন উদ্যোক্তা হিসাবে তার লক্ষ্য ঠিক করেন, বাজারে অনেক চাহিদা আছে এমন ডিজাইনের পোশাক তৈরি করতে হবে তাকে এবার। ক্রেতাদের জন্য ভালো মানের পণ্য নিশ্চিত করতে পারাই একজন উদ্যোক্তার আসল সার্থকতা। একজন উদ্যোক্তার সজাগ দৃষ্টি তার নিজের চলার পথকে খুঁজে নেয়। অনলাইনকেই মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে এগিয়ে যান উদ্যোক্তা মুক্তা। নিজের সহজ, সাবলিল উপস্থাপনা আর ভাল মানের পণ্য দিয়ে জয় করে নেন ক্রেতাদের মন। উদ্যোক্তা হবার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দুঃসাহসিক সংগ্রাম, মনোবলের গল্পগুলো অসাধারন। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আজ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন মুক্তা।
উদ্যোক্তা বার্তার সাথে কথোপকথনে উদ্যোক্তা বলেন, “আমি আমাদের দেশের মানুষকে গুণগত মানের পণ্য দিয়ে সফল উদ্যোক্তা হতে চাই। স্বপ্ন দেখি এগিয়ে যাবার নিজের উদ্যোগে“। ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে এই তরুণ উদ্যোক্তা জানান, “পণ্যের গুণগত মান ঠিক রেখে স্বল্প মূল্যে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছানো। শুরুটা হাতের কাজের ড্রেস দিয়ে, এখন নিজেই বিভিন্ন ডিজাইন করে পোশাক সরবরাহ করছি ক্রেতাদের কাছে এবং মাত্র তিন বছরেই দেশীয় ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও পাঠাচ্ছি পণ্য।”
পাঁচ জন কর্মী নিয়ে শক্তিশালী স্বপ্ন দেখে বাস্তবে কর্মযোগে এগিয়ে চলেছেন এই নারী উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তা আরও জানান, “একদিন অনেকগুলি মানুষের কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে আমার এই হাতের ছোঁয়া প্রতিষ্ঠান থেকে।” চাকরি করে প্রতিদিন ৯ টা থেকে ৫ টা সময় বেধে অফিস করে পরাধীন থাকতে চান না উদ্যোক্তা। “চাকরি করব না চাকরি দিব” এই প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছেন মুক্তা। নিজের সংসার সামলে, স্বামী-সন্তানের দেখাশোনা করে সাফল্যের পথে হাঁটতে চান এই তরুণী ব্যবসায়ী।
আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান এবং অদম্য মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলেছেন উদ্যোক্তা মুক্তা। সফলতার সাথে পরিচালনা করছেন স্বীয় ব্যবসা। কঠোর পরিশ্রম আর নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন সফল তরুণ উদ্যোক্তা।
মার্জিয়া মৌ ,
উদ্যোক্তা বার্তা