এপ্লাইড আর্ট হোম ইকোনোমিক কলেজে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করবার সময় বিয়ে হয়ে যায় তাহমিনা আহমেদ বানীর। পড়াশোনায় মন ছিলো না বানীর ছিলো ক্রিয়েটিভ কাজে। বিয়ে হয়ে গেলে পড়াশোনা করতে হবে না, তো বিয়ে করেই ফেলা যাক। নাসিম আহমেদ নিপ্পন এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন বানী। বিয়ের পর বানী দেখলেন এক ভিন্ন জগত নারীদের জন্য। সেখানে স্বামীর কাছে টাকা চাইতে হয়। যদি টাকা চাইতে না হতো? সবসময় বানী ভাবতে শুরু করলেন। আমি নিজে কিছু একটা করবো। এক মূহুর্ত বসে থাকতেন না বানী। নিজে কিছু করতে সারাক্ষণ চেষ্টা করতেন এবং তা থেকে কিভাবে উপার্জন করা যায় তাই ভাবতেন।
১৯৯৬ সালে কোল জুড়ে আসে সেমন্তী। মেয়ের প্রথম জন্মদিনে একটি কেক কিনে নিয়ে আসলেন বানী। খুব সাদাসিধে একটি কেকের সাথে একটা হামটিডামটি পুতুল বানিয়ে বসিয়ে দিলেন বানী। হাততালি আর আনন্দটা একটু ভিন্ন মাত্রায় যেন খেলে যায়। একটি প্রফেশনাল কেক তৈরির কোর্স করবেন, ভীষণ ইচ্ছা জাগে তাহমিনা আহমেদ বানীর মনে। কিন্তু সংগতি ছিলো না সেই সময়। কেক বানাতে শুরু করলেন নিজে। সিদ্দিকা কবির’স রেসিপিতে কেক বানানো শিখে নিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন একদিন দেখলেন ডল কেক বানানো। খুব দ্রুত কেক বানানো শিখে নিতে থাকলেন বানী। মোম বানাতে পারতেন আগে থেকেই। মোম, ব্লক-বাটিকের কাজ তো ইউনিভার্সিটিতেই শেখা।
কেকের সাথে পুতুল দিয়ে ডিজাইন করা শুরু করলেন বানী নিজেই। পরিবারের, বন্ধুদের যেকোন অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে নিজের বানানো কেক বানিয়ে নিয়ে যেতেন। বানী মনে মনে ভাবতেন আমার বানানো কেক যদি বিক্রি হতো। আমি যদি এটা থেকে টাকা উপার্যন করতে পারতাম। একটি ফেসবুক পেজ খুললেন বানী’স ক্রিয়েশন। প্রতিদিন একটি নতুন করে কেক বানান এবং তার ছবি তুলে দেন বানী’স ক্রিয়েশন এর পেজ এ। দেড় মাস পর প্রথম ফোন আসলো, অর্ডার আসলো একটি কেক এর। আর তা হলো মারমেইড ডিভাইন।
ডিজাইন নিয়ে গবেষণা সকল কাজ সম্পন্ন করলেন বানী। কাস্টমাররা আসলেন বানীর বাসায়। প্রথম অর্ডার দূরুদূরু বুকে বসে আছেন বানী। কেমন হবে কাস্টমারদের অভিব্যক্তি। যদি পছন্দ না হয়, যদি কেকটি তারা না নেন। কিন্তু সব টেনশন, চিন্তা-ভাবনা মূহুর্তেই উবে গেলো যখন দুই তরুণী কাস্টমার কেক দেখে খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন। বানীর হাতে প্রথম আসলো কেক বিক্রির তিন হাজার টাকা। আবেগে আপ্লুত হয়ে পরেন বানী। চিৎকার করে সকলকে সেদিন বলতে ইচ্ছে করছিল সবাই শোনো আমার একটা কেক সেল হয়েছে।
ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়ে উঠলেন বানী। স্বামী নাসিম আহমেদ নিপ্পন এবং বানী সিদ্ধান্ত নিলেন বানী ভীষণ প্রফেশনাল একটি কোর্স করবেন। এনটিভি কিউএফ, এনএইচটিটিআই এবং আইএলও’র যৌথ আয়োজনে একবছর ব্যাপী ব্রেড এন্ড কুকিস তৈরির একটি কারিগরি কোর্স সম্পন্ন করলেন বানী। উদ্যোমী, প্রত্যয়ী এবং আত্মবলে বলীয়ান বানী ইন্টার্নশীপ শুরু করলেন এক স্বনামধন্য বেকারিতে।
২০১৪ সাল। শিখলেন কেক বানানোর সকল কিছু। ফ্লেভার, টেকনিক, ফিনিশিংসহ যাবতীয় প্রয়োজনী সব শেখা এবং আয়ত্ত করলেন বানী। ইন্টার্নশীপ শেষ করে যেদিন বাসায় আসলেন বানী সেদিনই অর্ডার আসলো জঙ্গলবুক মোগলী ডিজাইনের কেকের। অর্ডার দিয়ে সারতে না সারতেই দুই কিশোর কিশোরীর একটি কেক এবং সেই সাথে দুইটি কাপ কেকের অর্ডার ডেলিভারি করবার সাথে সাথেই এক রিভিউ। ফুড ব্যাংক এর অনবদ্য এক রিভিউ পেলেন বানী। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বানীর। কাস্টমাইজড কেকের ভুবনে সাবলীল পদচারনা শুরু হলো। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি করে অর্ডার আসতে শুরু করলো বানী’স ক্রিয়েশনে। উৎসবের কেকের অর্ডার আসতে থাকে সাতশত। কাস্টমার হুহু করে বাড়তে থাকে। কয়েক বছরের মধ্যে ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্য ফেসবুক পেইজে। নিয়মিত ফেসবুক, ডিজিটাল মিডিয়ায় কাস্টমার কোয়ারিজ এবং অর্ডারের সবকিছু দেখতে শুরু করলেন বানী’র পরিবারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তা কন্যা সেমন্তী। মায়ের পাশে শক্ত হাতে দাঁড়িয়েছে প্রজন্ম।
২০১৭ সালে খিলগাঁও তালতলা তে প্রথম আউটলেট দিলেন বানী। ২০১৮ সালে গ্রীন রোডে দ্বিতীয় শাখা। ১৬ জন কর্মীর কর্মসংস্থান করেছেন বানী আজ। এপর্যন্ত দুই হাজারেরও বেশি ডিজাইনের কেক ডেলিভারি দিয়েছেন বানী। আজ ক্লাইন্ট লিস্টে হাজার হাজার ক্লাইন্ট। বানী’র কেক প্রথম আলো, ডেইলী স্টার, নিটল টাটা মোটরস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশ হেড কোয়ার্টারের বড় বড় সকল উৎসবে আজ বানী’র ক্লাইন্ট লিস্টে শখানেক কর্পোরেট এবং সেলিব্রিটির অর্ডার।
প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন বানী নিজেই। তার স্বপ্নের ভুবন বানী’স ক্রিয়েশন নিয়ে। আজ যেকোন থিম কেকের অর্ডার কিংবা যেকোন কাস্টমাইজড কেক যত বড়ই হোক না কেনো, তা তৈরি করে দিচ্ছেন নিমেষেই বানী। কেকের সাথে যেকোন আন্তর্জাতিক স্বাদের ডেজার্ট এর অর্ডার আর তা যত বড়ই হোক না কেন বা সংখ্যায় হোক না কেনো হাসি মুখে অর্ডারগুলো গ্রহণ এবং ডেলিভারীর কাজ করছেন সুদক্ষ নিপুণতার সাথে। স্বাস্থসম্মত ভাবে পরিপূর্ণ পরিবেশনায় এই উদ্যোক্তা।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা