গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। জন্মগ্রহণ করেন ঢাকায়, বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষাজীবন কেটেছে ঢাকাতেই। মাদ্রাসা পড়ুয়া এই ছেলেটি নটরডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী শেষ করেন ২০০৮ সালে। পড়াশোনা শেষ করেই চাকরি করার উদ্দেশ্যে চাকরি খোঁজা শুরু করেন তিনি। কথা বলছিলাম এসএমই সেক্টরের এক তরুণ উদ্যোক্তা কাজী মুহাম্মাদ মাজহারুল হকের সঙ্গে।
চাকরি খোঁজার শুরুতেই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেলেন মাজহারুল হক। সেখানে সরাসরি ফ্যাক্টরির কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে শুরু করেন কাজী মাজহারুল হক। তিনি বলেন, প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করার সুবাধে অনেক কিছু দেখা এবং শেখা হয়েছে তার। চাকরির পাশাপাশি তিনি শেয়ার ব্যবসার সাথে যুক্ত হন।
২০১১ সাল। চাকরীর বয়স বাড়লেও বেতন বাড়ানো হয়নি কোম্পানি কর্তৃক। দীর্ঘ তিন বছর চাকরি করায় কাজের অভিজ্ঞতা থেকে ব্যবসায়িক মনোভাব তৈরি হয় কাজী মাজহারুল হকের। চাকরি ছেড়ে দিলেন মাজহারুল। চিন্তা করলেন ব্যবসা করবেন।
২০১১ সালে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সেক্টরে ঘুরলেন। কি ব্যবসা শুরু করা যায়, নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন মাজহারুল হক। অনেককেই দেখেছেন পণ্য ক্রয় বিক্রয় করতে। কিন্তু তিনি চিন্তা করলেন যদি পণ্যগুলো নিজে উৎপাদন করা যায় তাহলে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। একবছর অবসরেই কাটলো কাজী মাজহারুল হকের।
২০১৩ সাল। ধানমন্ডির ৪-এ একটি অফিস ভাড়া নিলেন। ঠিক করলেন পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজ করবেন। পাটজাত পণ্য তৈরি করতে হলে ট্রেনিং দরকার। কিন্তু তিনি ট্রেনিং না নিয়ে পাটপণ্য তৈরি হয় এমন ২০-২৫ টি কারখানা পরিদর্শন করে কাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। পাট দিয়ে বেশ কয়েকটি ডিজাইনের ব্যাগ তৈরি করার কৌশল শিখে নিলেন এবং সেই কারখানা গুলো থেকে নিজের ডিজাইন করা ৩০ পিস ব্যাগ তৈরি করে নিলেন। প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন “কাজী ফ্যাশন হাউস”। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুললেন, নিজঃস্ব ফেসবুক পেইজের পাতা। তৈরি পণ্যগুলোর ছবি তুলে সেই পেইজে আপলোড করলেন। এবার পণ্যগুলো বিক্রয়ের পালা। পরিচিতদের মধ্যে পণ্য বিক্রয়ের জন্য নিজের অভিব্যক্তি জানালেন, বললেন তার ব্যবসার কথা, তার পেজ ভিজিটের কথা। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত এক কাজিনের মাধ্যমে বায়ার আসে তার অফিসে পণ্যগুলো দেখতে। বিদেশি বায়ার পণ্যগুলো পছন্দ করে কিনে নেন এবং নতুন আরও ৩৫০ পিস ব্যাগের অর্ডার দেন। ব্যবসায় প্রথম লাভজনক বিক্রয়ে যেন মনোবল বাড়িয়ে দিলো কাজী মাজহারুল হকের। মনস্থির করলেন সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
এভাবে একবছর দেশের বিভিন্ন গ্রাহকদের কাছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন অফিসে গিয়ে নিজের ডিজাইনে তৈরি পণ্যের বর্ণনা দিয়ে ছোট ছোট অর্ডার নিয়ে নিজের ব্যবসা বাড়ালেন উদ্যোক্তা মাজহারুল হক। পাটের পণ্য তৈরির পাশাপাশি তিনি ভাবলেন বাঁশের তৈরি পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করবেন।তিনি বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন ডিজানের পণ্য তৈরি করা ইউটিউব দেখে শিখলেন এবং বাঁশের পণ্য তৈরি করতে যে বাঁশ গুলো দরকার তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে তা সংগ্রহ করলেন। ২০১৫ সালে তিনি পাট এবং বাঁশের তৈরি পণ্যগুলো নিয়ে একটি মেলায় অংশগ্রহণ করলেন। কিন্তু সেখানে কোন লাভের মুখ দেখেননি মাজহারুল হক।
২০১৫ সালে বিসিকের আওতায় আবারও একটি মেলায় অংশগ্রহণ করেন। সেখানে ভালো সাড়া পান এবং বেশ কয়েকটা অর্ডারও পান। তারপর থেকে বিসিকের যে মেলাগুলো হয় সেই মেলায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। ব্যবসার ধারাবাহিক উন্নতি হওয়ায় তিনি ভাবতে থাকেন , এই সেক্টরগুলোতে আরও ভালো করে কাজ করতে হবে। তাই জেডিপিসি (জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশনাল সেন্টার) থেকে ১৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণ নিলেন। ২০১৭ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে নিলেন ফ্যাশন ডিজাইনের উপর ট্রেনিং। ২০১৮ সালে বিসিক থেকে বাঁশের তৈরি পণ্যের উপর ট্রেনিং নেন।
উদ্যোক্তা ইউবি প্রেস কে জানান, ২০১৮ সালে “৬ষ্ঠ জাতীয় এসএমই মেলা”, ২০১৯ সালে “৭ম জাতীয় এসএমই মেলা” এবং শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত প্রথম “জাতীয় শিল্প মেলায় ২০১৯”-এ অংশগ্রহণ করে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন।
উদ্যোক্তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে পাটজাত পণ্য তৈরি করতে বর্তমানে ১০ জন কর্মী কর্মরত আছে। বাঁশ দিয়ে পণ্য তৈরির কাজে ২৫-৩০ জন কর্মী ময়মনসিংহ, যশোর ও দিনাজপুর এলাকায় কর্মরত আছে। তবে বর্ষা মৌসুমে বাঁশের কাজগুলো বন্ধ থাকে বলে তিনি জানান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্যোক্তা ইউবি প্রেসকে বলেন, আমি আমার দেশকে সোনালী অতীতের আধুনিক রূপে রুপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি পাটজাত পণ্য তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে নতুন আঙ্গিকে। আমার প্রতিষ্ঠান “কাজী ফ্যাশন হাউজ” কে পাটের আন্তর্জাতিক ব্রান্ডে পরিণতি করতে চাই।
কাজী ফ্যাশনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে ও ব্রান্ড হিসেবে পরিচিত করে তুলতে আমি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।পাটের আন্তর্জাতিক বাজারে কাজী ফ্যাশন হাউজকে সুপরিচিত করার ক্ষেত্রে যদি সরকারি সহায়তা পাই তবে আমার প্রতিষ্ঠানকে একটি আন্তর্জাতিক মানের ব্রান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো বলে আশা রাখি।
খুরশিদা পারভীন সুমী
ছবি- ইকবাল আপন