বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার কালুরপার এলাকায় ‘প্রকৃতি’ নামের একটি সংগঠনের প্রকল্প ‘বিবর্তন হ্যান্ড মেইড পেপার প্রজেক্ট’ কচুরিপানা থেকে কাগজ তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন গ্রামের সাধারণ অনেক নারী।
একসময় কচুরিপানা আগাছা হিসেবে পরিচিত ছিল। জলাশয়ে জন্ম নেয়া এ উদ্ভিদটি এখন বরিশালের প্রায় এক’শ নারীর জীবিকার প্রধান উৎস। দেশের বাজারে খুব একটা চাহিদা না থাকলেও বাংলাদেশের নালা-ডোবায় জন্ম নেয়া কচুরিপানা দিয়ে তৈরি পণ্য বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশে যাচ্ছে। কচুরিপানা দিয়ে তৈরি করা হয় কাগজ। আর সেই কাগজ দিয়েই তৈরি হয় ৩০টিরও বেশি পণ্য। এইসব পণ্য যাচ্ছে ইতালি, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে।
বিবর্তন হ্যান্ড মেইড পেপার প্রজেক্ট ১৯৯৩ সালে হস্তশিল্পের কাজ শুরু করে। শুরুটা ১১/১২ জনকে নিয়ে হলেও এখন কাজ করছেন প্রায় এক’শ নারী। বিদেশি একটি সংস্থা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেয় এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
ডোবা-নালায় সৃষ্টি হওয়া কচুরিপানা প্রথমে সংগ্রহ করে সেগুলো পরিষ্কার করে কেটে গরম পানিতে সেদ্ধ করা হয়। পরে কচুরিপানার সঙ্গে পরিত্যক্ত কাগজ মিশিয়ে পেস্ট করা হয়। সেই পেস্ট কাপড়ে লাগিয়ে আগুনের তাপে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে কৈরি করা হয় কাগজ।
সংগঠনটির অধিকাংশই নারী কর্মী। তারা জানান, কচুরিপানা থেকে বিভিন্ন রঙের কাগজ তৈরি করে তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন।
দেশব্যাপী সংগঠনটির ২৯টি ইউনিট রয়েছে। এসব ইউনিটে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩ হাজার। আর প্রতি বছর কমবেশি ২০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়। এতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকায় এখানে কাজ করা কর্মীরা জানান, নিজেদের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিদেশে যাচ্ছে। তা দেশ ও নিজেদের জন্য গর্বের। এসব কাজে ভালো বেতন পাওয়ায় সাংসারিকভাবেও স্বচ্ছল হয়েছেন তারা।
এই সংগঠনে টানা ২৭ বছর ধরে কাজ করছেন পশ্চিম সুজনকাঠি এলাকার সুনীতি কর। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে কচুরিপানা দিয়া কাগজ তৈরি হয়। এ কাজ করে আমার ছেলেদের পড়াশুনা করাইছি। এদের মধ্যে ছোট ছেলে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। আমরা ভালোই আছি। আমাদের এই কাজগুলা সব বিদেশে নিয়া যায়। হাজার হাজার আইটেম বানাই। যার মধ্যে জুয়েলারি আইটেম বেশি। সেগুলোও কচুরিপানার কাগজ দিয়েই তৈরি হয়।’
২৫ বছর ধরে কাজ করছেন শীলা কীর্তনীয়া। তিনি এখানে কার্ড, ছবি ফ্রেম, নোট বুক, বক্স আর অ্যালবাম বানান। এই কাজ করেই তার সংসার চলে।
কচুরিপানার এ কাগজ দিয়েই ৩০টিরও বেশি পণ্য বানানো হচ্ছে। নোটবুক, ঝুড়ি, ঘর সাজানোর সামগ্রী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাপিয়ে বিশ্বের ২৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ বিষয়ে বিবর্তন হেন্ড মেইড পেপার প্রজেক্টের ইউনিট ম্যানেজার অঞ্জন কুমার বিশ্বাস বলেন, যে জিনিসগুলো সবাই ফেলে দিচ্ছে, ব্যবহার করছে না সেগুলো ব্যবহার করে আমরা নানা পণ্য তৈরি করছি। প্রতিনিয়ত বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে আমরা কথা বলে যাচ্ছি। দেশের চেয়ে দেশের বাইরে প্রোডাক্টগুলোর চাহিদা বেশি। আমাদের প্রতিটি কর্মী ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিবছর আমরা বিপুল পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে প্রায় এক’শ নারী কাজ করেন। তবে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন ৬০ জন। ইতালি, জার্মানি, কানাডা, কোরিয়াসহ প্রায় ২৫টি দেশ থেকে অর্ডার আসে। আমরা তাদের চাহিদা মোতাবেক কাজ করে থাকি। আমাদের যে ক্রিয়েটিভ কাজগুলো রয়েছে সেগুলোও তারা নিয়ে থাকে।’
তিনি বলেন: এখানে যারা কাজ করেন তারা প্রায় সবাই প্রত্যন্ত এলাকার নারী। অনেকের অনেক ট্র্যাজেডি আছে জীবনে। আমরা পাঁচ থেকে নয় হাজার টাকা বেতন দিয়ে থাকি। আর এই প্রজেক্ট থেকে আমাদের মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় হয়ে থাকে।
বিশ্বের ৯০ জন বায়ার এসব পণ্য ২৫টি দেশে বিক্রি করেন উল্লেখ করে বিবর্তন হেন্ড মেইড পেপার প্রজেক্ট ডেপুটি ডিরেক্টর সজল কৃষ্ণ দত্ত বলেন, আমাদের নারী কর্মীর সংখ্যাই বেশি। কাজেই আমরা আমাদের প্রজেক্টের মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারছি।
প্রসঙ্গত ৯০ দশকে গড়ে ওঠা এমসিসি নামের একটি এনজিও প্রথম কচুরিপানা দিয়ে কাগজ তৈরির কাজ শুরু করে।
সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা