তখন আমি বেশ ছোট। মায়ের সাথে লাউ, শিম, পেঁপে, লেবু, করলা, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া,শসা ইত্যাদি বীজ বপন করতাম। বপন শেষে মুখ থেকে হাল্কা থুথু ছিটিয়ে মাটিতে হাত বুলিয়ে দিতাম। আর এ কাজটা করতাম সন্ধ্যার পর পর। মা বলতো সন্ধ্যায় গাছ লাগালে কম বড় হবে এবং বেশি ফল ধরবে। অর্থাৎ বীজ বপনের সাথে মানুষের হাটার সম্পর্ক রয়েছে। বীজ বপনের পর মানুষ যদি বেশি হাটে তবে গাছ অধিক লম্বা হবে আর ফল/সবজি কম হবে। তাই সন্ধ্যায় চারা লাগানো ভাল। আশে পাশের সবার চেয়ে আমাদের সবজি ভাল হতো তাই সবাই এক রকম হিংসে করতো। আর তারা জিজ্ঞেস করলে মা বলতেন সবুজ লাগিয়েছে। হাসতে হাসতে কথা গুলো বললেন উদ্যোক্তা কে এম সবুজ।
বাড়ির চারপাশের মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনরা সবুজকে দিয়ে বীজ বপন করতে শুরু করলো। কেউ কেউ খুশি হয়ে পঁচিশ-পঞ্চাশ পয়সা কেউবা ১ টাকা পযর্ন্ত দিতেন যা পেয়ে সবুজ বীজ বপনের পর খুব খুশি হতো। এভাবে গাছ আর প্রকৃতির প্রতি একটা গভীর মিতালি তৈরি হলো সবুজের।
১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকে সিলেট হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) মাজারে বেড়াতে গিয়ে সেখানে একটি নার্সারী চোখে পড়ে অধিক আগ্রহ নিয়ে নার্সারীতে যায় সবুজ। ঐ সময় চোখে পড়ে একটি বনসাই। অধিক আগ্রহ নিয়ে বনসাই কি তা জানতে চান। নার্সারির লোকেরা বললেন বনসাই হলো একটি বড় গাছের ছোট রূপ। অর্থাৎ প্রকৃতির বুকে একটি বড় গাছ যে রকম দেখায় ঠিক ঐ রকম দেখতে কিন্তু ছোট থাকবে। কৌতূহলী সবুজের উত্তর, কিভাবে তা সম্ভব একটি গাছ লাগালে তো বড় হয়ে যাবে আর এত মোটা ও সুন্দর কিভাবে সম্ভব, মাথায় ধরছে না, কোথাও কিছু একটা ঘাপলা আছে। আরো গভীরে জানতে চেষ্টা করলো সবুজ। তারা কি বলছে আর বলছে না কিছুই বুঝতে পারছেনা সবুজ, কিভাবে এটা করলো তারা। নানা ভাবে তাদের কাছ থেকে জানতে চেষ্টা আর মনে মনে স্থির করলো নিজেই করবে।
যেই দেখা সেই কাজ, ঢাকায় ফিরে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে ৪ টা তেতুল গাছের চারা কিনে বনসাই চর্চার যাত্রা শুরু। যার সাথে দেখা হতো তাকেই শুধু বনসাই নিয়েই নানা প্রশ্ন, কেউ সামান্য জেনে বলতো, কেউ কিছু না জেনে ধারণা থেকে বোঝাতে চেষ্টা করতো। উদ্যোক্তা বলেন, সেই সময় প্রায় প্রতি রাতেই বনসাই নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম।
২০০৭ সালে প্রথম আলোতে দেখলাম ঢাকায় বনসাই বিষয়ক প্রশিক্ষণ হবে। তাদের সাথে যোগাযোগ করে বনসাই প্রশিক্ষণ ও ইকেবানা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলাম। ২ মাসেই একাডেমি বনসাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বেশ ভালই চলছিল। এদিকে প্রায় ১০ -১২ বছর পার হয়ে গেল কোনো আউট পুট নেই শুধু খরচ আর খরচ বেড়েই চলছে। বাগানে গাছের চারার সংখ্যা বেড়ে গেছে। টব,মাটি, সার, কিটনাশক ইত্যাদি মিলে মাসে ভালই খরচ হতো। এদিকে কোনোরূপ আউটপুট না পেয়ে রাগের বসে বড় ভাই তার বন্ধ-ুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে আমার তৈরি করা বনসাইগুলো দিতে শুরু করল। এ নিয়ে বড় ভাইয়ের সাথে ঝগড়া এবং রাগ করে কিছু দিন বাড়ির বাহিরে থাকা এবং বনসাইও সরিয়ে নিতে হলো। তখন উপায় না পেয়ে পাশের এক নার্সারীতে মাসিক চুক্তি ভিক্তিতে বনসাই রাখতে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে দেখা গেল এখান থেকে নানা সময় ভালো ভালো বনসাইগুলো চুরি হতে লাগলো। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঐ সময় হঠাৎ করে একটি বনসাই ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হলে পরিবারের লোকজন নড়েচড়ে বসে। এর পর তেতুল ১৭ হাজার ও পাকুড় ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করলাম।
তখন পরিবারের সবাই চিন্তা করলো এটা দিয়ে কিছু একটা হওয়া সম্ভব। ২০০৭ সালে একাডেমিক বনসাই প্রশিক্ষণের পর বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদের চিন্তা মাথায় ঢুকে সবুজের, কিভাবে বনসাই চাষাবাদ করা যায়। অপরদিকে মানুষের উৎসাহ- উদ্দীপনায় কাজ করায় আরো বেশি সাহস যোগাতে থাকে। এদিকে বনসাই বিক্রি ভালই হতে লাগলো। শুরুর দিকে পরিবার এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা নানা সমালোচনা করতে লাগলো। বনসাই কি এটা থেকে কত কেবি কাঠ পাওয়া যায়, যদি কাঠ না হয় তবে এর দাম এতো বেশি কেন? কোথায় বিক্রি হয়, যারা কিনে তারা নিয়ে কি করে? এটি কি মাথায় করে নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতে হয় কিনা। না হলে মানুষ কি করে জানে! এতো এতো প্রশ্ন।
সবুজ আবারও হেসে বলে, আমাকে দেখলে বলতো গাইচ্ছা সবুজ ঐ দেখ গাইচ্ছা সবুজ যাচ্ছে! এরকম নানা সমালোচনা করতো। সমালোচনার পর যখন তারা দেখতো বনসাই নিয়ে মাতামাতি আরো বেড়ে যাচ্ছে তখন তারা আস্তে আস্তে চুপ হতে থাকল। এদিকে বনসাই নিয়ে এক এক করে দেশে প্রতিটা খবরের কাগজে আমার ছবিসহ লেখা ছাপা হতে থাকলো এবং টেলিভিশনে দেখানো হলো আমার বনসাই। নানা প্রতিবেদন টকশো হতো তখন তারা চুপ হতে লাগলো।”
বাণিজ্যিক ভাবে বনসাই নিয়ে কাজ শুরুর পর শুধু মাত্র ঢাকার বনসাই প্রশিক্ষণে সন্তুষ্ট থাকতে না পেরে এরপর চীন ও মালেশিয়াতে বনসাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেন তিনি। ভারতে অনুষ্ঠিত দুই বাংলা বনসাই প্রশিক্ষণ কর্মসুচীতে প্রধান অতিথির আসন অলংকরণ করেন সবুজ। যতদিন যাচ্ছে বনসাই শিল্পচর্চা নিয়ে নানা স্বপ্ন যেন ততোই বড় হতে থাকে। এখনো মাঝে মাঝে ঘুমে বনসাই স্বপ্নে দেখেন উদ্যোক্তা সবুজ। এর মধ্যে বনসাই তৈরিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ‘লিভিং আর্ট’ নামে একটি বনসাই প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছেন। বনসাইকে ভালোবেসে ও জলবায়ু মোকাবেলা ও পরিবেশ উন্নয়নে ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় ৫ লক্ষাধিকেরও বেশি গাছের চারা বিতরণ করেছেন। শুধু গাছের চারা বিতরণই নয় প্রতি মাসের ১ম শনিবার ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে নানা কর্মসূচী চালু করা; তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য গাছ চেনা, গাছের উপকারিতা, গাছ রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি এবং মায়েদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভ্রাম্যমান সবজির বীজ বিতরণ কর্মসূচী চালু করা। লাউ, সিম, করলা, পুঁইশাক, শসা, ঢেঁড়শ, বরবটি ইত্যাদির বীজ বিতরণ করে যাতে তারা গাছপ্রেমি ও নিরাপদ সবজি খেতে পারে। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের হাতে গাছের চারা তুলে দেয়া এই বৃক্ষপ্রেমী উদ্যোক্তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা