আজকের উদ্যোক্তা বার্তায় সেসব উদ্যোক্তাদের জীবনগল্প তুলে ধরা হবে যারা আগামী দিনে বিশ্ব পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। আজকের এই গল্প পড়ে কেউ যদি উদ্যোক্তা হতে নিজের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, তবে অনেক বড় কিছু পাওয়া সম্ভব।
বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জে জয়ী কিছু অদম্য ক্ষুদে উদ্যোক্তার গল্প নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
নোয়া মিন্তজঃ
নোয়ার যখন ব্যবসায় হাতেখড়ি তখন তার বয়স ৮ বছর। কি শুরু করেছিল এই ক্ষুদ্র বয়সে? সে ছোট বয়সেই ভালো আর্ট করা রপ্ত করেছিল। আর এটাকে কাজে লাগিয়ে গ্রীষ্মের বন্ধে অল্প ফিয়ের বিনিময়ে শিশুদের জন্য আর্ট ক্লাস পরিচালনা শুরু করে। এখানেই থেমে থাকেনি নোয়া, এর দুই বছর পর শুরু করে ‘শিশুদের জন্য পার্টি পরিকল্পনা’ ব্যবসা। নিজের কর্মচারীরা যেন কর্মক্ষেত্রে প্রটোকল মেনে চলে সে জন্য একটি নির্দেশিকাও লেখে এই ক্ষুদ্র বয়সে।
নোয়ার বয়স এখন ১৬ বছর। সে এখন নেনিস বাই নোয়া (Nannies by Noa) কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। এটি নিউইয়র্ক সিটির একটি নেনি সরবরাহকারী পূর্ণ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে গ্রাহক সেবা, নেনিদের background check, পরিবারগুলোর চাহিদা মেলানো সব কাজই নোয়া করে। নোয়ার কোম্পানিটি ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক সিটিতে কয়েক শ পরিবারের জন্য নেনি সরবরাহ করেছে।
দুই বছর আগে নোয়া যখন হাইস্কুল শুরু করতে যাচ্ছিল তখন সে তার কোম্পানির জন্য একজন ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সিইও নিয়োগ করেছিল। সঙ্গে দুজন সহকারী। নোয়া বলে, সবচেয়ে ভালো দিক হলো, আমি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছি এবং এখানে অনেক মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটা আমার জন্য অনেক উৎসাহ সৃষ্টি করে। নোয়া ফরচুন ম্যাগাজিনের ১৮ বছরের নিচে উদ্ভাবনশীল ১৮ জন উদ্যোক্তাদের মধ্যে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
জর্জ মেতুসঃ
জর্জের বয়স এখন আঠারো। কিন্তু হাইস্কুলে থাকা অবস্থায় জর্জ তার কোম্পানি টিলের (TEAL) জন্য ২.৮ মিলিয়ন ডলার সিড মানি সংগ্রহ করে। জর্জ এমন একটি ড্রোন নকশা করে যা ব্যাটারিচালিত ক্যামেরা সংযুক্ত দ্রুতগামী ড্রোন। এই ড্রোনটি পেশাদারি কাজে ব্যবহার করা যাবে। আর এই কমার্শিয়াল ড্রোন বিক্রি করবে জর্জের কোম্পানি টিল।
জর্জের ড্রোনের বৈশিষ্ট্য হলো এটি খুব দ্রুতগতি সম্পন্ন, ঘণ্টায় ৭০ মাইলের চেয়েও বেশি ও ঘণ্টায় ৪০ মাইল বাতাসের বেগের মধ্যেও স্থির থাকতে পারে। এটি শক্তিশালী ক্যামেরা যা দ্রুতগতিতেও উন্নত ছবি ও 4K ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম। এর একটি ড্রোন কিনতে হলে আপনাকে ব্যয় করতে হবে ১২৯৯ ডলার। জর্জের ইচ্ছা হলো নেতৃত্বদানকারী প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করার।
মো ব্রিজেজঃ
মোর বয়স এখন ১৪ বছর। আমেরিকার হাইস্কুল হিসাব হয় নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। সে হিসাবে মো হাইস্কুলেরই ছাত্র। কিন্তু এই হাইস্কুলে থাকা অবস্থায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার দৌড়ে। শুধু তাই নয়, আমেরিকার বিনিয়োগ পাওয়ার অনুষ্ঠান সার্ক ট্যাংক থেকে বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই মো একটু ফ্যাশন সচেতন। এখানে স্কুলের ছেলেরা সাধারণত নেক টাইয়ের পরিবর্তে বড় টাই পড়তে পছন্দ করে। মোও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু সমস্যা ছিল তার রুচি ও চলনের সঙ্গে মানানসই বড় টাই খুঁজে পাওয়া। আর সেখান থেকেই মো ডিজাইন করে ফেলে নিজের রুচি ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই কিছু বড় টাই এবং দাদির সহযোগিতায় সেগুলো তৈরি করেও ফেলে। এ থেকেই মোর উদ্যোক্তা হওয়ার সূত্রপাত।
মোর কোম্পানির নাম মও’জ বওজ (Mo’s Bows)। তার কোম্পানি পুরুষদের হাতে তৈরি করা নানা রঙের বড় টাই, নেক টাই ও অন্যান্য মেনস জিনিসপত্র তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। আমেরিকার পরিচিত কোম্পানি bloomingdale’s ও Neiman Marcus-এ মো অংশীদারি কোম্পানি হিসেবে আছে। মোর স্বপ্ন হলো আগামী ২০ বছরের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক নামকরা পোশাক কোম্পানির মালিক হওয়া। কিন্তু তার আগে একজন ভালো ডিজাইনার লেখাপড়া শেষ করা।
রেচেল জিয়েটজঃ
রেচেলের বয়স এখন ১৬ বছর। তার কোম্পানির নাম গ্লাডিয়েটর লেক্রস (Gladiator Lacrosse)। মূলত লেক্রস খেলার সামগ্রী বিক্রি করে থাকে। তার কোম্পানি আশা করছে এ বছর ২ মিলিয়ন ডলার আয় করবে। রেচেল শুধু এই কোম্পানির সিইও নয়, সে একজন ভালো লেক্রস খেলোয়াড় বটে। ২০১৫ সালে সে আমেরিকার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সার্ক ট্যাংকে বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল। ব্যবসার প্রতি আগ্রহ রেচেলের ছোটবেলা থেকেই। পাঁচ বছর বয়সে নিজের বাসার সামনে কোমল পানির একটা স্ট্যান্ড দিয়েছিল। সে আগ্রহের পরিণতি আজকে তার কোম্পানি মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বেন পাস্তেরনেকঃ
বেনের বয়স এখন ১৭ বছর। সে ফ্লগ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও। ফ্লগ হলো একটি সামাজিক কমিউনিটি ও ভার্চ্যুয়াল মার্কেট, যেখানে তরুণেরা নিজেদের মধ্যে পণ্য বেচাকেনা ও বিনিময় করতে পারে। এটি সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবারপরিজন ও নিজ এলাকাতে অনলাইন বেচাকেনার একটি দারুণ মাধ্যম। যদিও বেন অস্ট্রেলিয়া বংশোদ্ভূত কিন্তু সে তার পরামর্শকের পরামর্শে হাইস্কুল ছিঁড়ে নিউইয়র্কে পাড়ি জমায়। বেন তার কোম্পানির জন্য ২ মিলিয়ন ডলার তোলে যেখানে সিলিকন ভ্যালির নামকরা বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বেন একটি গেম ডিজাইন করে যেটি সে সময় ১.৩ মিলিয়ন বার ডাউনলোড করা হয়েছে। এত অল্প বয়সে সে ম্যানহাটনের মতো জায়গায় লাক্সারি দালানে ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে। বেন প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে এবং ৭ জনের একটি প্রযুক্তি দলকে নেতৃত্ব দেয়। ফ্লগ অ্যাপটি আপনারা অ্যাপল স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে পারেন।
শুভাম ব্যানার্জিঃ
শুভামের বয়স এখন ১৪ বছর। ২০১৪ সালে ১২ বছর বয়সী শুভাম ব্যানার্জির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল Braigo ল্যাবস। এটি একটি প্রিন্টিং প্রযুক্তি যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজে প্রিন্ট করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানুষের উপকার করার জন্য একটি ইনকরপোরেটেড মানবিক অপ্টিমাইজ প্রযুক্তির বিকাশ করা হয়। কোম্পানির গবেষণা, নকশা, সৃষ্টি ও উন্নয়ন প্রসারের জন্য প্রযুক্তিভিত্তিক প্রবর্তিত এবং পরিসেবাসহ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সেবা প্রদান করে। শুভাম ভবিষ্যতে চিকিৎসাবিদ্যার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে চায়।
বেঞ্জামিনঃ
যদিও তার নাম বেঞ্জামিন কিন্তু লোকে তাকে স্নিকার ডন নামেই চেনে। বেঞ্জামিনের বয়স এখন এখন ১৬ এবং এই ২০১৬ সালে তার কোম্পানির স্নিকার ডনের বিক্রির টার্গেট ১ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। স্নিকার ডন ব্রান্ডের এক্সক্লুসিভ স্নিকার রিসেল করে থাকে।
বেঞ্জামিনের বয়স যখন ১১ কি ১২ তখন তার মা তাকে নাইকি ব্রান্ডের এক জোড়া স্নিকার কিনে দেয়। কিন্তু সে যখন স্কুলে যায়, তার স্নিকার জোড়া তার বন্ধুর পছন্দ হওয়াতে তার কাছে বেশি দামে বিক্রি করে দেয়। এরপর তার মাকে সে আরেক জোড়া কিনে দিতে বলে এবং অনুরূপভাবে বিক্রি করে দেয়। এ থেকেই এক নতুন ব্যবসায়ের ধারণা তার মাঝে আসে। সে নিয়মিত খুচরা দোকান থেকে এক্সক্লুসিভ স্নিকার কিনে বিক্রি করতে থাকে। এর থেকেই জন্ম হয় স্নিকার ডনের। এখন তার ব্যবসা অনেক বড় এবং তার এক্সক্লুসিভ স্নিকার সংগ্রহের উৎস গোপনীয়। তার অনলাইন স্টোরে বিভিন্ন ব্রান্ডের স্নিকার প্রতি জোড়া বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ হাজার টাকা থেকে ৮ লাখ টাকা মূল্যের মধ্যে পাওয়া যায়।
লগান গুলেফঃ
গুলেফের বয়স এখন ১৪ বছর। সে একজন খাদ্য উদ্যোক্তা। গুলেফ সেশন-২-এর মাস্টার শেফ জুনিয়র বিজয়ী, ২০ হাজারেরও অধিক প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে থেকে সে বিজয়ী হয়। তার ব্রান্ড লগানস রাব (Logan’s Rub) বিভিন্ন ধরনের মসলা ব্লেনড তৈরি করে। সে একটি ক্লাবও পরিচালনা করে যেখানে সে ছোট পার্টির জন্য রান্না করে। গুলেফ তার প্রথম রেসিপি তৈরি করে মাত্র ৮ বছর বয়সে এবং এরপর একটি লাইভ টেলিভিশনে ২৫টি স্থানীয় খাবারের প্রদর্শনী করে।
গুলেফের ভবিষ্যৎ ইচ্ছা হলো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সেলিব্রিটি শেফ হবে এবং রান্নার ওপর নিজের একটি টেলিভিশন শো চালু করবে।
বেঞ্জামিন স্তেরনঃ
বেঞ্জামিনের বয়স এখন ১৭। তার কোম্পানির নাম নহবো। তার কোম্পানি মূলত পরিবেশ বাঁচান স্লোগান নিয়ে প্লাস্টিক ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত যত্নের পণ্য সামগ্রী যেমন শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, হ্যান্ড ওয়াশ, বডি ওয়াশ, সেভিং ক্রিম ইত্যাদি তৈরি ও বাজারজাত করে। পণ্যগুলো সাধারণত একবারই ব্যবহার যোগ্য এবং সহজে পানিতে দ্রবণীয় বল আকারের। কোম্পানিটি সর্ব প্রথম পরিবেশবান্ধব শ্যাম্পু বল তৈরি করে এবং অন্যান্য পণ্যগুলো তৈরির পথে রয়েছে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বেঞ্জামিন প্লাস্টিকের ভয়াবহতা সম্পর্কে একটি ডকুমেন্টারি দেখেছিল। মূলত সেখান থেকেই তার মনে পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরির স্বপ্ন জাগে। পরে ফ্রি লেঞ্চ কেমিস্টের সহযোগিতায় প্রোটোটাইপ তৈরি করে। বেঞ্জামিন অবশ্য সার্ক ট্যাংক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তার কোম্পানির ২৫ ভাগের বিনিময়ে ১ লাখ ডলার বিনিয়োগ লাভ করে।
এ কাজ করতে গিয়ে অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছে। এরপরও তারা দমে যাননি। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে থেমে থাকেননি। সবসময় ধৈর্য, সাহস ও মনোবল চাঙ্গা রেখে নিজ লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন। পাছে লোকের কটু কথা ঝেড়ে ফেলে উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্যের দিকে ছুটে চলেছেন।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)