জীবনের সবচেয়ে কাছাকাছি সমর্থক শব্দ কি যুদ্ধ নয়? প্রতি পদে পদে এখানে আমাদের টিকে থাকার লড়াই। অনেকে এ-যুদ্ধে পরাজিত হন আবার অনেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে হয়ে উঠেন সংশপ্তক। জীবনযুদ্ধে তেমনই একজন সংশপ্তক উদ্যোক্তার নাম শিরিন সুলতানা। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা চলছিলো।সাহিত্য জগতে প্রজাপতির মতো হেসে খেলে উড়ে বেড়ানো জীবন ছিলো তার। বাবার ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে বড় চাকুরিজীবী বানাবেন। কিন্তু বিধি বাম। পড়ালেখা চলা কালেই হঠাৎ ডাক্তাদের ভুল ওষুধ প্রয়োগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মুমূর্ষু অবস্থায় বাবা দেশের বাইরে নিয়ে গেলেন তাকে বাঁচাতে। মরতে মরতে বেঁচে উঠলেন। প্রবল আত্মবিশ্বাস আর ইচ্ছে শক্তির জোরে সে যাত্রায় নিজের অসুস্থতাকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। নিজের অসুস্থতার ভেতর জানতে পারেন তার বাবার শরীরে বাসা বেধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। শুরু হলো আর এক যুদ্ধ, বাবাকে বাঁচানোর যুদ্ধ।
চাকরি না পাওয়ার অপরাধে বাবার আদুরে মেয়েটি অসুস্থার মধ্যেও টানা তিনবছর অবহেলা আর অনাদর ছাড়া আর কিছু পাননি। তার বাবার এমনটা করার যথেষ্ট কারণ ছিলো। তিনি ২০১৭ সাল থেকে ক্যান্সার পেসেন্ট, ২০১৯ সালে তার লেরিন্স ভোকাল কড কেঁটে বাদ দেওয়া হয়, গলার ভেতর একটা মেশিন সেট করা সেটা দিয়ে কথা বলেন আর ফুসফুস থেকে সরাসরি শ্বাস নেন। বাবার চিকিৎসার পেছনে তিন বছরে ৩৪ লক্ষ টাকা খরচ করেন শিরিন নিজে হাতে। দেশের বাইরে মাসের পর মাস কাঁটতে হয় তাদের। একবেলা খেয়ে আর একবেলা না খেয়েও দিন কেঁটেছে। এমনও সময় গেছে, টানা তিনদিন ভাত চোখে দেখেননি। দোকানের অল্প দামের শুকনো পোড়া রুটি, পানি দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে কেঁটেছে দিনের পর দিন রাতের পর রাত।
ভারতে দিন যাপন করতে করতে, ওখানকার সাংস্কৃতি দেখতে দেখতে একধনের অনুপ্রেরণাবোধ জন্ম নিলো তার ভেতর। ওখানকার মেয়েরা বাজারে মাছ কুঁটে বিক্রি থেকে শুরু করে বড় বড় বিজনেস সামলাচ্ছে অথচ শিরিন নিজ দেশে চাকরি চাকরি করে নিজের সময় ও জীবন ফেলে দিয়েছেন হতাশার জলে। ওখানে বসেই সিদ্ধান্ত নিলেন জীবনটাকে বদলাবেন, ইচ্ছেটাকে ইচ্ছে মতো খাটাবেন। বাবার চিকিৎসার জন্য তাদের সব অর্থ-সম্পদ শেষ করে নিঃস্ব হাতে ফিরে আসেন দেশে। বাবা তার শ্বাসনালী আর লেরিন্স হারিয়ে হতাশার সমুদ্রে ডুবে গেছেন। তিনি চান শিরিন চাকরি করে সংসারের হাল ধরবেন; সংসার চালাতে না পারেন অন্তত তার পেছনে প্রতিদিন যে ৪৯০ টাকা খরচ হয় সেটা যেন চালাতে পারেরেন।
হতাশার চূড়ান্ত সীমায় একদিন বাড়ি ছেড়ে যশোরে চলে এসে মেসে উঠলেন। লেখালেখি করার সূত্রে যশোরের গণ্যমান্য বহু লোক তাকে চেনেন। ব্যবসার স্বপ্ন লালন করলেও পুঁজির অভাবে আবার শুরু করলেন চাকরি খোঁজা। মাত্র দুহাজার টাকা আয়ের জন্য দোরে দোরে ঘুরলেন। কেউ এতো ছোট পদে তাকে মানায় না বলে চাকরি দেয়নি; কেউ জয়েন্ট দিতে বলে ফোন বন্ধ রেখেছে। হতাশ হয়ে গেলেন। কাছে আছে মাত্র ৫০০টাকা (মায়ের সঞ্চয় করা টাকা, বাড়ি থেকে বাবা বের করে দিলে মা টাকাটা দিয়েছিলেন) মেসে প্রতিমাসে খরচ ২০০০ টাকা। কতদিন চলতে পারবেন সেটা অনিশ্চিত। হতাশা চলছে, হতাশায় চলছে। তখনই তিনি একটা অনলাইনে ‘কারুভূমি’ নামে একটি পেজ খুলে টুকটাক সেল দিতে শুরু করলেন ভারতীয় পণ্য। তার বন্ধু মিলন আশরাফ প্রথম তাকে বললো, তুমি দেশিয় পণ্য নিয়ে কাজ করো, যশোরে তো হাতের কাজের সমাহার। শিরিন বললেন, ‘পুঁজি কই পাবো?’। বন্ধু মিলনই প্রথম দুইটা জামার অর্ডার দেন এবং ১৮০০ টাকা এডভ্যান্স করেন। সেই টাকা দিয়ে চারটা জামার কাপড় কেনেন উদ্যোক্তা শিরিন। আবার হতাশা, কোথায় পাবেন কর্মী? কিভাবে কি করবেন কিছুই জানা নেই, কিন্তু হাল ছাড়লেন না। যশোর শহরের রাস্তায় মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের কাছে গিয়ে কাজ দেখেছেন, শিখেছেন, জেনেছেন।
করোনার ভেতর দুবেলা না খেয়ে থেকেছেন তবু হাল ছাড়েননি। একসময় সামনে ঈদ, ঈদেই সেল হলো অনেক প্রোডাক্ট, ব্যাস আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যশোরে নিজের প্রতিষ্ঠান কারুভূমি-র একটি শো-রুম খুলতে সক্ষম হয়েছেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে যেতে পথিমধ্যে হঠাৎ অনলাইনে Women and e-commerce forum (we)-এর সন্ধান পান এবং সদস্য হন। এখানে শিরিন প্রতিনিয়ত বিজনেস সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহন করছেন, প্যাকটিক্যালি প্রয়োগ করছেন। তার জীবনে এনে দিয়েছে টিকে থাকার আত্মশক্তি।
নিজের সংগ্রামমুখর উদ্যোক্তা জীবনের সফলতা সম্পর্কে উদ্যোক্তা বলেন,’এখন চিৎকার করে বলতে পারি, আমি আর না খেয়ে থাকি না। বাবাকে সপ্তাহে কিছু হেল্প করতে পারি। মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেই এইভেবে যে আল্লাহ্ বাবাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সে যদি না থাকতো তবে আমার ভেতর জীবনকে পাল্টে ফেলার আগুন জ্বালতো কে? আমার প্রতিষ্ঠানে বাবা এসে যখন চারপাশটা ঘুরে ফ্যালফ্যাল করে টলমল চোখে তাকিয়ে থাকে। তখন এক অজানা বিশ্বাসের ডানায় ভরপুর আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে, বাবার ঠোঁটের মুগ্ধ হাসি দেখে বলতে ইচ্ছে করে আমরা হেরে যাইনি’।
উদ্যোক্তা আরও বলেন, ‘আমি সফল উদ্যোক্তা হয়ে বৃদ্ধাশ্রম নয় নিজের তৈরি বাড়িতে অসহায় বাবা-মায়েদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিবো। মেয়েদের কর্মসংস্থান করবো আর উন্নত ক্যান্সার হসপিটাল তৈরিতে সরকার কে সহযোগিতা করতে চাই’।
তিনি তার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন করেন হাতে সেলাইয়ের নকশীকাঁথা, বেডসিট, মেয়েদের শাড়ি, থ্রিপিস, অনপিস জামা, পাঞ্জাবি ও বেবিড্রেস। বর্তমান তার কর্মী সংখ্যা ৫৫ জন। ডিজাইনার আছেন দুইজন। উদ্যোক্তা নারীদের ও বেকারদের উদ্দেশ্যে বলেন “হতাশা নয়, বসেথেকে নয় সময়কে কাজে লাগিয়ে রাস্তা খোঁজো তুমিও পারো আপন আলোয় জ্বলে উঠতে,নিজের ভরপুর বাঁচো, আপজনদের ভালো রাখো”।
সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা
জানা জীবন-গল্প পুনরায় পড়লাম;মন খারাপ হলো।
তারপর আবার জীবনীশক্তি পেলাম।কবি শিরিন সুলতানার জন্য শুভকামনা।