গুগলে বিশ্বের প্রথম নারী উদ্যোক্তা সম্পর্কে সার্চ করলে যে নামটি উঠে আসে তা ম্যাডাম সি জে ওয়াকার এর। তিনি প্রথম আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নারী (আসল নাম সারাহ ব্রেডলাভ) যাকে বলা হয় আধুনিক প্রসাধনী শিল্পের অগ্রদূত। গিনিস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস দ্বারা স্বীকৃ্ত প্রথম মহিলা মিলিওনিয়ার যিনি তার সমূদয় সম্পদ পেয়েছেন না উত্তরাধিকারসূত্রে, না বিবাহসূত্রে।
তিনি একাধারে ছিলেন একজন বিচক্ষণ ব্যবসায়ী, উদ্ভাবক এবং উদ্যোক্তা। আধুনিক চুলের যত্ন এবং প্রসাধনীসামগ্রীর অগ্রগামীদের মধ্যে একজন হিসেবে, ম্যাডাম ওয়াকার এখনও অনেকের কাছে ব্যবসা করার জন্য অনুপ্রেরণা। নিজের চুল হারানোর ত্যাক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই চুলের জন্য বিউটি প্রোডাক্ট তৈরির পরিকল্পনা করেন। নিজের চেষ্টায় হওয়া আমেরিকার প্রথম মিলিওনিয়ার এই নারী।
আমেরিকার প্রথম স্ব-প্রণীত নারী ধনকুবের এর জন্ম হয়েছিল লুইসিয়ানায় এক ক্রীতদাস পরিবারে ১৮৬৭ সালে। মাত্র সাত বছর বয়সে সি জে ওয়াকার অনাথ হন। বাবা-মাকে হারিয়ে একমাত্র বোন লুভেনিয়ার কাছে মিসিসিপির ভিক্সবার্গে চলে যান। কিন্তু বোনের স্বামীর মারাত্মক অত্যাচার তাকে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য করে। ১৭ বছর বয়সে সারাহ লেলিয়া নামে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। দুঃখজনকভাবে মেয়ে লেলিয়ার দ্বিতীয় জন্মদিনের পর, একটি দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যু হয়। মাত্র ২০ বছর বয়সে বিধবা এবং সিঙ্গেল মা, একটু ভালো জীবন যাপনের আশায় একমাত্র মেয়েকে নিয়ে সেন্ট লুইসের পথে রওনা করেন। সেখানে দেখা হয় তার সহোদর চার ভাইয়ের সাথে যারা নরসুন্দর হিসাবে কাজ করতেন। সারাহ সেখানে লন্ড্রি আর রান্নার কাজ নেন। তিনি প্রায় ১৮ বছর দৈনিক ১.৫০ ডলার বেতনে প্রতিদিন ১৪ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতেন।
১৮৯০ এর দিকের কথা। সারাহর বয়স তখন প্রায় ৩০। কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের চুলের ত্বকের রোগে আক্রান্ত হয়ে চুল পরে যাওয়া খুব মামুলি একটা রোগে পরিণত হয়েছিল। অনেক আফ্রিকান-আমেরিকান নারীর মতো তিনিও তার চুল হারিয়েছিলেন। সারাহ এক ফার্মাসিস্টের রান্নার কাজ করতে গিয়ে তার কাছ থেকেই মৌলিক রসায়নবিদ্যা আয়ত্ব করেন। ঘরেই বিভিন্ন উপাদান দিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা আর ফার্মাসিস্টের সহায়তায় তিনি তার নিজস্ব শ্যাম্পু এবং মলম তৈরি করতে সক্ষম হন। প্রথমে বন্ধুদের ও প্রতিবেশীদের কাছে দরজায় দরজায় গিয়ে বিক্রি করতে শুরু করেন। সেন্ট লুইসের নারীরা তার এই চুলের যত্নের পণ্য অতি আগ্রহের সাথে কিনতে শুরু করল।
১৯০৫ সালে তিনি কাজের সুবাদে ডেনভারে চলে যান। সেখানে সংবাদপত্রের প্রকাশক চার্লস জোসেফ ওয়াকারের সাথে পরিচয় হয় এবং তারপর বিয়ে। তার স্বামীর সাথে মিল রেখে তার নাম হয় ম্যাডাম সি জে ওয়াকার। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সারা দেশ জুড়ে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা তখনই তার পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহী হবেন যদি তারা তার পণ্য সম্পর্কে জানতে পারেন।
১৯০৮ সাল। শ্যাম্পু, মলম সবার মন কেড়ে নেয়। স্বামীর সহায়তায় তিনি সংবাদপত্রে পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার ও একই সাথে মেইল অর্ডার এর ব্যবসা শুরু করেন। ব্যক্তিগতভাবে বিক্রয় করতে গির্জা গ্রুপ এবং ক্লাব পরিদর্শন করতে শুরু করেন। নিজস্ব ক্যাটালগ তৈরি করেন। খুব জলদি ওয়াকার মার্কেটিং মাস্টার হয়ে ওঠেন। এর আগে কেউ কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের চুলের চাহিদা এভাবে পূরণ করতে পারেনি যা ওয়াকার করে দেখিয়েছিলেন। ওয়াকার প্রথম ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞাপনে ফটোগ্রাফির আগে এবং পরে “নিজের ছবি ব্যবহার করেছিলেন।
সারা দেশজুড়ে একদল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিক্রয়কর্মী নিয়ে ওয়াকারের কোম্পানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকলো। মসৃণ চুলের জন্য ওয়াকার তার বিক্রয়কর্মীদের ‘দ্যা ওয়াকার মেথড’ নামে একটি পদ্ধতি শেখান যার মধ্যে ছিল স্কাল্প প্রস্তুতি, লোশন প্রয়োগ এবং গরম লোহার চিরুনি ব্যবহার করার উপায়। এই এজেন্টরাই আমেরিকা জুড়ে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের কাছে ‘ওয়াকার এজেন্টস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
১৯১০ সালে উদ্যোক্তা ইন্ডিয়ানাপলিসে চলে যান এবং পণ্য উৎপাদন এর জন্য একটি কারখানা চালু করেন। বিউটিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ এর জন্য তিনি “হেয়ার কালচার কলেজ” স্থাপন করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান জুড়ে প্রায় ৪০,০০০ আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষ এবং মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেন। ১৯১৭ সালের মধ্যে ম্যাডাম সি জে ওয়াকার ম্যানুফ্যাকচারিং কোঃ আমেরিকার সবচাইতে সফল ব্যবসা আর ম্যাডাম ওয়াকার নিজের চেষ্টায় তৈরী প্রথম নারী মিলিওনিয়ার এ পরিণত হন। আমেরিকান ইতিহাসে প্রথম মহিলা কোটিপতি, পাশাপাশি দেশের সবচাইতে ধনী কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে বিবেচিত সি জে ওয়াকার মাত্র ৫১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)
সুরাইয়া আলম