ইউটিউবে এখন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের একটা অংশ হয়ে আছে। যাদের হাতে স্মার্ট ফোন আছে, তারা সবাই ইউটিউব ব্যবহার করে থাকে। কেউ গান শুনে থাকি, কেউ নাটক দেখে থাকি, কেউ সংবাদ দেখে থাকি, কেউ কেউ আবার শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখে থাকি, কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা ইউটিউব এর উদ্যোক্তা একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণ কম্পিউটার বিজ্ঞানী।
আজকের উদ্যোক্তা বার্তায় আন্তর্জার্তিক পর্বে পরিচিত হবো সেই তরুণের সাথে। ইউটিউবের তিন জন উদ্যোক্তার মধ্যে একজন হচ্ছেন জাওয়াদ করিম যিনি প্রথম ইউটিউব এর ভিডিও উপলোড করেন। এই ভিডিওটির নাম ‘ME AT THE ZOO’। জাওয়াদ করিমের জন্ম জার্মানির Moosburg (মোসবার্গ ) এ ১৯৮৯ সালে। তাঁর বাবা নাইমুল করিম একজন প্রবাসী বাংলাদেশী। যিনি নিজেও একজন বিজ্ঞানী। মা ক্রিস্টাইন করিম জার্মান নাগরিক। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিনিসোটা ইউনিভার্সিটির বাইকেমিস্ট্রির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক।
ছোটবেলা থেকেই জাওয়াদ ছিলেন একটু চুপচাপ প্রকৃতির। কিন্তু চুপচাপ হলে কি হবে। তাঁর মাথার মধ্যে নানা রকম ক্রিয়েটিভ চিন্তা ঘুরপাঁক খেত। ছোটবেলা থেকেই আবিষ্কারের নেশা তাকে পেয়ে বসতো। আর তাঁর ফলাফল আজকের ইউটিউব।
জাওয়াদ করিমের ১৩ বছর পর্যন্ত বেড়ে উঠা জার্মানিতে। পরবর্তীতে লেখাপড়া করেন আমেরিকায়। জাওয়াদ করিম বেড়ে উঠেছেন জার্মানিতে কিন্তু ১৯৯২ সালে তাঁর পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। জাওয়াদ করিম সেইন্ট পল সেন্ট্রাল হাই স্কুল থেকে পড়াশোনা শুরু করেন এবং পরে আরবানা শ্যামপেইনে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিভাগে অধ্যায়ন করেন।
ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ইন্টারনেট ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান paypal (পেপালে) চাকরি শুরু করেনএবং একই সাথে লেখাপড়া চালিয়ে যান। এছাড়া ১৯৯৮ সালে জাওয়াদ একজন ইন্টার্ন হিসাবে সিলিকন গ্রাফিক্স ইনকর্পোরেটে কাজ করেন। সেখানে তিনি গবেষণায় সাফল্য অর্জন করেন। কম্পিউটার বিজ্ঞানী গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করার পর, ষ্টেনফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানী মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
ইউটিউব তৈরী করার আইডিয়া জাওয়াদের মাথায় প্রথম কিভাবে আসে সে প্রসঙ্গে জাওয়াদ জানান-“২০০৪ সালে একজন অভিনেত্রীর ভিডিও ক্লিপ অনেক খুঁজেও অনলাইনে পাননি। তখন চিন্তা করেন একটা ওয়েবসাইট তৈরির যেখানে সবাই ভিডিও শেয়ার করতে পারবে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই অর্থাৎ এক জায়গা থেকে যে কোনো ভিডিও শেয়ার করে মুহূর্তেই তা পৌঁছে যাবে বিশ্বের প্রতিটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে। উদ্যোক্তা জাওয়াদ করিম আরও বলেন -প্রতিষ্ঠার ১৮ মাসের মধ্যে আমাদের ওয়েবসাইট নিয়ে আমরা আলোচিত হই। সাধারণ মানুষের কাছে আমরা খবরের শিরোনাম হই। তাদের অনেকেরই জিজ্ঞাসা ছিল আমরা কোথায় থেকে এই আইডিয়া পেলাম, আমি তাদের সব সময় একটা কথাই বলি, চারদিকে সবসময় মেধাবী মানুষ থাকে। তাঁদের খুঁজে বের করতে হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর এই চিন্তা সাফল্য লাভ করে। আর ইউটুব এ প্রথম ভিডিও ছিল ‘ME AT THE ZOO’ (চিড়িয়াখানায় আমি) ২৩ শে এপ্রিল ২০০৫ এ আপলোড করা হয়েছিল। ২০২০ সাল এর ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভিডিওর ভিউ ছাড়িয়েছে ৬.৭মিলিয়ন। এই ভিডিওতে দেখা যায় হাতির সামনে দাঁড়িয়ে হাতির বর্ণনা দিচ্ছেন জাওয়াদ করিম।
২০০৪ সালে পেপালে চাকরি করার সময় chad Hurley (চ্যাড হার্লি) ও steve Chen ( স্টিভ চেন ) এর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে জাওয়াদ করিমের। স্টিভ ছিলেন একজন কম্পিউটার সাইন্স এর ছাত্র। হার্লি মূলত পেনসালভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিন জন উদ্যোক্তা নতুন কিছু করতে চাইতেন। এমন কিছু করতে চাইতেন যাতে পুরো পৃথিবী অবাক হয়ে যায়।
ইউটিউব এর ধারণা নিয়ে জাওয়াদ যখন তাঁর দুই সহকর্মীর সাথে কাজ শুরু করেন তখন তিনি ষ্টেনফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে লেখা পড়া করছিলেন। এসময় তিনি লেখাপড়ার দিকে মনোযোগী ছিলেন। ইউটিউব এ তিনি একজন সাধারণ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিলেন। পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে সাইটটি তে গ্রাহকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া পেতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে squiva venture নামক বিনিয়োগ সংস্থার বিনিয়োগে ইউটিউব কে উন্মুক্ত করলেন। ২০০৬ সালে গুগল ইউটিউব কে কিনে নিলো। ২০০৬ সালে ইউটিউব যখন google এর কাছে তিন বন্ধু বিক্রি করে দেন তখন ৬৪ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিলেন জাওয়াদ করিম।
২০০৬ সালে google এর ইউটুব অধিগ্রহণ করার আগ পর্যন্ত ইউটুব এর প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা হিসেবে জাওয়াদ করিমের নাম সেভাবে উচ্চারিত হয়নি। পরবর্তীতে বিক্রির সময় এই তরুণ বিজ্ঞানীর নাম ছড়িয়ে পরে, অর্থাৎ এর মধ্যে দিয়ে জাওয়াদ করিম একজন ধনি ব্যক্তিতে পরিণত হন। এ ধরণের একটি আবিষ্কারের জন্য জাওয়াদ করিম ও তাঁর বন্ধুদের করতে হয়েছে অনেক পরিশ্রম।
২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে ইলিনয় উনিভার্সিটিতে এসোসিয়েশন মেশিন ফর কম্পিউটারিং মেশিনারি সম্মেলনে ইউটিউব এর ধারণার উপর বক্তব্য রাখেন জাওয়াদ করিম। সেখানে ইউটিউব নিয়ে জাওয়াদ তাঁর মূল্যায়ন সম্পর্কে বলেন- ‘সবারই সম্ভবত ইউটিউব নিয়ে পছন্দ -অপছন্দের মিশ্র অনুভূতি আছে। কারণটা মনে হয় ইউটিউব নিজেই। একদিকে ইউটিউব যেমন প্রত্যেক রাতে নতুন সব ভিডিও দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে।, ঠিক উল্টো ভাবে বলা যায় রাতের পর রাত এইসব ভিডিও দেখার কারণে ইউটিউব সবার মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। ইউটিউব এর কারণে যাদের সিজিপিএ গ্রেড কমে গেছে তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।
অনেকে হয়তো জেনে খুশিই হবেযে ইউটিউব তোমার চেয়ে আমার অনেক বেশি সময় নষ্ট করেছে। যে কারো থেকে বেশি সময় ভিডিও দেখতে গিয়ে বেশি সময় নষ্ট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে আমার প্রথম শিক্ষা ছিল, কোনো কিছুর প্রতি নাছোড় বান্দার মতো লেগে থাকলে তা চূড়ান্ত ফল আনবেই।‘
জাওয়াদ করিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরে এক প্রতিষ্ঠিত ইন্টারনেট ভিত্তিক অর্থ লেনদেন কোম্পানিতে চাকরির সুযোগপান। এই চাকরিটা জাওয়াদ করিমের জন্য ছিল একটা বড় সুযোগ। উদ্যোক্তা বুঝতে পারছিলেন না পড়াশোনা বাদ দিয়ে কোম্পানিতে যোগ দেয়ার জন্য এই সুযোগটা গ্রহণ করাটা এই মুহূর্তে ঠিক হবে কিনা। উদ্যোক্তা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে ২ সপ্তাহ সময় নেন। পরে পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়াতে পেপাল সদর দপ্তরে যাবার সিদ্ধান গ্রহণ করেন। জাওয়াদ বলেন- ‘যখন ঝুঁকি গ্রহণের সুযোগ পাবে তা আর অবহেলা করবে না।
ইউটিউব ছাড়াও আরো বেশ কিছ প্রকল্পে কাজ করেছেন জাওয়াদ করিম। যেমন -পোর্টেবল ত্রিমার্তিক গ্রাফিক্স, সলভিং ডাট পাজল, থ্রিডি স্প্রিং সিমিউলিসন, রোবোচিত ওয়েবক্যাম, রেডিও সিটি ইঞ্জিন, রেট রেসার, লাইফ থ্রিডি, কোয়াকটু মডেল ভিউয়ার সহ বেশ কিছু প্রজেক্টের উদ্ভাবক জাওয়াদ করিম।
২০০৮ সালের মার্চে জাওয়াদ করিম এক নতুন উদ্যোগ নেন, ইউনিভার্সিটি বিষয়ক ছাত্রদের প্রযুক্তি বিষয়ক আইডিয়া এবং বিশ্ব বিদ্যালয় পড়ুয়া বা বিশ্ব বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হওয়া উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক চিন্তা বাস্তবায়নে সাহায্য করা হয়।
জাওয়াদ করিমের এই উদ্যোগ তরুণদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)