ইংরেজিতে পড়া শখের মুরগিওয়ালা

0
উদ্যোক্তা মোঃ সাজ্জাদুল ইসলাম আপন

মুরগির খামার থেকে মাসে খরচ বাদ দিয়ে ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করছেন বগুড়ার গাবতলি এলাকার মোঃ আব্দুল কাইয়ুম তরফদার এবং স্বপ্না বেগম দম্পতির সন্তান মোঃ সাজ্জাদুল ইসলাম আপন। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে জি পি এ ফাইভ অর্জনের মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক শেষ করে পরবর্তিতে বগুড়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং বর্তমানে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত রয়েছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।

ছোটবেলা হতেই পশু-পাখি খুব ভালোবাসতেন। বাসাতে কবুতর এবং কিছু শখের পাখি পালতেন যত্ন করে। তবে পড়াশোনার সুবাদে আপনকে থাকতে হতো মেসে। করোনা মহামারী শুরু হলে বাসায় ফিরে আসেন এবং আধুনিকতার যুগে হাতে স্মার্ট ফোন থাকায় পাখি রিলেটেড সামাজিক পাতায় যে গ্রুপ এবং পেজ গুলো রয়েছে সেগুলো সার্চ করে ফলো করতে শুরু করেন। এভাবে মুরগি নিয়ে কিছু পেজ ও গ্রুপের সাথে পরিচিত হন। পছন্দ হলে সেখানে দামও জানতে চাইতেন, তবে ছাত্রাবস্থায় হাতে টাকা না থাকায় ক্রয় করতে পারতেন না। হঠাৎ মাকে একদিন বলেন তাকে কিছু টাকা দেওয়ার জন্য। মায়ের দেওয়া সেই ১,০০০ টাকা নিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী বড় ভাই আতাউস সামাদ রাহুলের কাছ থেকে দু’টি সিল্কি মুরগির ১ মাস বয়সি ১ জোড়া বাচ্চা সংগ্রহ করেন আপন। সেখান থেকেই জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু।

সিল্কি প্রজাতির সাথে এখন যুক্ত হয়েছে কোচিন, বেন্থাম, পলিশকেপ, ফ্রিজেল, ফনিক্স, ইয়োকোহামা, অনাগাদুরি, সেব্রাইট, হোয়াইট ফেস স্পানিস, রোসকম্ব, সুমাত্রা ও ফাইটার এবং বিশ্বের সব থেকে ছোট জাতের মুরগি মালয়েশিয়ান শো-সেরেমা এবং বড় জাতের আমেরিকান ব্রাহমাসহ ১৮ জাতের মুরগি। সবই রয়েছে শখের মুরগিওয়ালার খামারে। সেগুলো থেকে প্রতিদিন ১০-১৫ টি ডিম সংগ্রহ করেন এবং প্রতি সপ্তাহে ৫০ থেকে ৬০টি বাচ্চা জন্ম নেয়। বাচ্চাগুলো বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ২,০০০ টাকা জোড়ায় এবং প্রাপ্ত বয়স্ক মুরগি ৪ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। সবমিলিয়ে খরচ বাদ দিয়ে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থীর পড়াশোনা চলমানরত অবস্থায় মুরগির খামার থেকেই মাসে ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয়।

মেধাবী সন্তান যখন পড়াশোনার পাশাপাশি মুরগি পালন শুরু করেছিলেন সেটি দেখে খানিকটা অবাক এবং রাগান্বিত ছিলেন বাবা। সেটি যে খুব অস্বাভাবিক তা কিন্তু নয়, সন্তানের পড়াশোনার দিক বিবেচনা করে বাবা-মা শাসন করতেই পারেন এটিই বরং স্বাভাবিক। আপন এর সাথেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বাবার প্রথম দিকে অমত ছিল ছেলের এমন সিদ্ধান্তে। তেমনি প্রতিবেশীরাও। নানা আলোচনা-সমালোচনা করেছেন তাকে নিয়ে। সামনে পেছনে বহুবার খোঁচা দিঢে বলেছেন ইংরেজি পড়া মুরগির খামারি। তাতে কি? নিজ স্বপ্নে বদ্ধপরিকর ছিলেন আপন। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছেন বড় কিছুর– অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। সন্তানের সফলতা এবং ব্রাহমা জাতের মুরগির রাজকীয় চালচলন দেখে মুগ্ধ হয়ে বাবার রাগও এখন গলে জল।

উদ্যোক্তা বার্তার সাথে কথোপকথনকালে আপন ওরফে শখের মুরগিওয়ালা বলেন, “শখ থেকে শুরু হলেও এটি এখন আমার পেশা। ইতোমধ্যে এই উদ্যোগে আমার সমবয়সী তিন তরুণের কর্মসংস্থান হয়েছে। মুরগির বাচ্চাগুলো জন্মানোর কয়েক সপ্তাহ যেহেতু সাবধানে, বিভিন্ন নিয়ম-কানুম মেনে চলতেতে হয়; তাই সে সময়টা তারা বাসায় নিয়ে পরিচর্যা করেন। ‘শখের মুরগিওয়ালা’ নামক আমার যে পেজ রয়েছে সেখানেও পেজ দেখভালের জন্য আমার কিছু সমবয়সী ও ছোট ভাইয়েরা রয়েছেন। সবথেকে ভালো লাগার বিষয় আমি আমার পরিবারকেও সাপোর্ট দিতে পারি।”

ইংরেজি সাহিত্য পড়াশোনা করছেন, শেষ হলে ভালো চাকরির অফার ফেলে কি উদ্যোগ সেখানেই ছেড়ে দেবেন? নাকি চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: অবশ্যই আমার উদ্যোগ পরিচালনা করে যাবো। আমার স্বপ্ন বিদেশি মুরগি নিয়ে বৃহৎ একটি খামার থাকবে আমার যেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। চাকরি পেলেও অবশ্যই সেটির পাশাপাশি গুরুত্ব সহকারেই উদ্যোগও এগিয়ে নিয়ে যাবো।

বাসায় ছোট একটা মাচার ঘরে নেট কাঠ দিয়ে ৩ তাকের ৯ টা খাঁচা বানিয়েছিলেন আপন এবং তার ছোট ভাই আবিদ। মুরগি সংখ্যা বাড়তে থাকায় এবং ছেলের এমন সাফল্যে রাগান্বিত বাবাও পাশে দাঁড়িয়ে নতুন খাঁচা তৈরি করে দেন। বাসার মধ্যে লম্বায় ২০ ফিট এবং প্রস্থে ১০ ফিট ৩ তলায় ১৮ খোপের এই খামার করতে ব্যয় হয়েছিলো প্রায় ৬০ হাজার টাকা। যা তাদের এক মাসের আয়ে উঠে এসেছে।

দেশের ৫৫টি জেলায় ইতোমধ্যে মুরগী পৌঁছে দিয়েছেন এই স্বপ্নবাজ তরুণ। প্রতিনিয়ত দূরদূরান্ত থেকে তার মুরগির খামার দেখতে বাসায় ভিড় জমাচ্ছেন অনেকেই। কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ ইতোমধ্যে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে তার মুরগির প্রদর্শন করে উপজেলা এবং জেলা পর্যায় হতে সম্মাননা অর্জন করেছেন আপন। যারা তার মতো বিদেশি মুরগি পালন করতে চান তাদের একেবারে লাখ টাকা ব্যয় করে মুরগি না কিনে অল্প টাকায় ২/৩ জোড়া কিনে কাজ শুরুর পরামর্শ দেন এই তরুণ। এতে ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে বলে জানান তিনি। আপন তার কাজের মাধ্যমে আরো একবার প্রমাণ করলেন কোনো কাজই ছোট নয়। বরং মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারাই বেশি সম্মানের।

তামান্না ইমাম,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here