অদম্য মনোবল উদ্যোক্তা ইয়াসমিনের চালিকা শক্তি

0

মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বড় হওয়া দুই ভাই এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় লাইলা ইয়াসমিন। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা ও একজন সরকারি চাকুরীজীবি ছিলেন। তাই ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একজন উচ্চ পর্যায়ের সরকারি চাকুরীজীবি হবেন। পড়াশোনা শেষ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগ থেকে। স্নাতকোত্তর অর্জন করেন প্রথম শ্রেণী নিয়ে।

ছোট বেলার সেই স্বপ্নটা আরো জোড়ালো হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরী হওয়ার পরও তা ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় আসেন বিসিএস পড়াশোনার জন্য। এর মধ্যেই যোগদান করেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে চাকুরীরত অবস্থায় বিয়ে হয়। আর বিয়ের পর পড়াশোনা শিঁকেয় ওঠে। ছোট বেলার সেই স্বপ্নকে ভুলে শুরু হয় বেসরকারি সেক্টরে চাকুরী জীবন। এটাও বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি মা হওয়ার পর।

হতাশা থেকে বের হতেই খুবই ছোট পরিসরে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। কিন্তু অনেক মূলধন লাগে বিধায় বেশিদিন ব্যবসা চালাতে পারেননি। তাই আবারো শুরু করেন পড়াশোনা ও গুগল ঘাটাঘাটি। সন্ধান পেলেন লুম বিডিং বা ওয়েভিং (তাঁতে বোনা) গয়নার। মূলত এই গয়নাগুলো অধিকমাত্রায় ব্যবহৃত হয় আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে। বাংলাদেশে এখনও এই গয়নার প্রচলন তেমন চোখে পড়ে না। সেখান থেকেই ধারনা পেলেন নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করার। খোঁজ খবর নিয়ে ট্রেনিংও নিলেন । এরপর শুরু হল করোনা পরিস্থিতি। অন্যান্য পরিবারের মতো ইয়াসমিনের পরিবারও আর্থিক কষ্টে পড়লো। মূলত এই সংকটাপন্ন করোনা পরিস্থিতি ও আর্থিক সমস্যাই তাকে একজন প্রকৃত উদ্যোক্তা করে তোলে।

শুনতে একটু অন্যরকম মনে হলেও হতাশা ভরা জীবন-মই ছিল উদ্যোক্তার বড় অনুপ্রেরণা। কোনো কিছু করার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তার অনুপ্রেরণা। আমাদের সমাজে পিছিয়ে পরা মানুষগুলোকে যারা হেয় প্রতিপন্ন করে তাদের সেই মানসিকতাই ছিল অনুপ্রেরণার অংশ ।

বর্তমানে কাজ করছেন মূলত হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের গয়না নিয়ে। যেমন: লুম বিডিং বা ওয়েভিং (তাঁতে বোনা) গয়না, পাট, কাঠ, ক্লে, ফেব্রিক এবং বিডস এর তৈরি গয়না। এর মধ্যে লুম বিডিং বা ওয়েভিং (তাঁতে বোনা) গয়না সিগনেচার পণ্য। এই গয়নাগুলো ছোট হস্ত চালিত তাঁতে ঘর হিসেব করে সূতো বেঁধে একটা একটা করে পুতি গুণে বুনন করতে হয়। এরপর তাঁত থেকে কেটে হাতে ফিনিশিং এর কাজ করতে হয়।

অন্যান্য গয়না তৈরির তুলনায় তাঁতে বোনা এই গয়না তৈরি অনেক কষ্ট ও সময় সাপেক্ষ। একেকটি গয়না তুলতে কমপক্ষে ২-৩দিন সময় লাগে। উদ্যোক্তা বলেন, “আমি আমার উদ্যোক্তা জীবনে এই ইউনিক ও কষ্ট সাধ্য কাজটিকেই বেঁছে নিয়েছি আমার সিগনেচার পণ্য হিসেবে।”

একজন উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি প্রথমেই তার পণ্য সম্পর্কে ব্যাপক জানার চেষ্টা করেন। গয়নার উৎপত্তি, ব্যবহার এবং প্রচলন সম্পর্কে। জানতে পারেন যে সিগনেচার পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তা মূলত আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকাতে বেশি ব্যবহৃত হয়। যেহেতু তাদের সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। তাই তিনি প্রতিনিয়ত গবেষণা করেছেন, আমাদের সংস্কৃতির সাথে রিলেট করে কিভাবে ইউনিক হিসেবে কাস্টমারদের কাছে উপস্থাপন করা যায়। যেমন: পুজো, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ফাল্গুন, বৈশাখ, ১৬ ডিসেম্বর এই মটিফ গুলোকে কাজে লাগাচ্ছেন তিনি । তার গবেষণা তার পণ্যকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ডিজাইন নিয়ে কাজ করছেন ইয়াসমিন এবং তা যাতে ইউনিক হয় সে দিকগুলো বিশেষ ভাবে খেয়ালও রাখছেন। কাস্টমারদের সাথে রিলেশন বিল্ডআপে কাজ করছেন। যার ফল স্বরূপ অনেককেই রিপিট কাস্টমার হিসেবে পেয়েছেন।কাস্টমারদের রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী কাস্টমাইজ কাজের অপশন রেখেছেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করছেন। সিগনেচার গয়না ছাড়াও জুট, কাঠ ও অন্যান্য গয়নার ক্ষেত্রেও ইউনিকনেস ক্রিয়েট করেছেন।ফেইসবুক মার্কেটিং নিয়ে কাজ করছেন।এছাড়াও কাস্টমারদের সাথে সরাসরি রিলেট হতে বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।

খুব সামান্য পরিমাণ মূলধন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। টাকার অংকে বলতে হলে মাত্র ১০,০০০ টাকা । এর মধ্যে কাজ শেখা, ম্যাটেরিয়াল কেনা এবং অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রথমদিকে তত সাড়া না পেলেও এখন প্রতি মাসে বেশ ভাল আয় করেছেন তিনি । যা এতো অল্প সময়ে একজন উদ্যোক্তার আশার থেকেও বেশি। একজন সফল উদ্যোক্তা হতে গেলে সর্বপ্রথম ধৈর্য থাকতে হবে, নিজের কাজের প্রতি ডেডিকেশন থাকতে হবে, লেগে থাকার মানসিকতা রাখতে হবে, প্রতিনিয়ত নিজের পণ্য নিয়ে গবেষণা করতে হবে এবং পণ্যে নতুনত্ব ক্রিয়েট করতে হবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তা ইয়াসমিন। তিনি মনে করেন, একজন সফল উদ্যোক্তা হবার জন্য অবশ্যই ট্রেনিং গুরুত্বপূর্ণ। ট্রেনিং দক্ষতা বৃদ্ধিতে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর হাতে কলমে ট্রেনিং তো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
উদ্যোক্তা নিজেকে যেমন সফল দেখতে চান, ঠিক তেমনি পিছিয়ে পরা নারীদের জন্য কাজ করতে চান। তিনি নারীদেরকে প্রকৃত অর্থে স্বাবলম্বী করতে চান, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে চান। এবং তাদের হাত ধরেই তার উদ্যোগ Muaz’s Collection কে সফলভাবে বড় করতে চান।

মার্জিয়া মৌ,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here