বাবা-মায়ের ছোট কন্যা রোফাইদা খুরশিদ লিটা। বাবা পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। সেই সুবাদে চাকরি করেছেন ইরাক যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং তৈল ও শোধনাগার মন্ত্রণালয়ে। পরবর্তীতে সস্ত্রীক পাড়ি জমান আল-আইনে। দীর্ঘ সাড়ে সতের বছর চাকরিরত ছিলেন আল-আইন পৌরসভায়। মধ্যপ্রাচ্যের এই সুন্দর শহরেই জন্মগ্রহণ করেছেন রোফাইদা খুরশিদ লিটা ও তার বড় বোন। তবে মধ্যপ্রাচ্যে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেয়ার প্রচলন না থাকায় জন্ম সনদ সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশ থেকে।
লিটার বয়স যখন মাত্র দেড় বছর তখন বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের মাটিতেই প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের আদরের দুই কন্যাকে। এই চিন্তাভাবনা থেকেই দেশে ফিরলেন রোফাইদা খুরশিদ লিটার পরিবার এবং বসবাস শুরু করলেন রাজধানী ঢাকাতে তাদের স্থায়ী ঠিকানায়।
রোফাইদা খুরশিদ লিটা। তিনি হিসাব ও অর্থ বিষয়ে স্নাতক পাশ করেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি- বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে। এর পরপরই ২০১৪ সালে চাকরি জীবনের যাত্রা শুরু করেন ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেডে।
লিটার ছোটবেলার ইচ্ছা ছিল ব্যাংকে চাকরি করার এবং সৌভাগ্যক্রমে সেই ইচ্ছাটাও পূরণ হয়। চাকরি করার সুযোগ পান ব্রাক ব্যাংকে। স্বাভাবিকভাবেই কাটছিল সুন্দর সেই দিনগুলো। তবে এক পর্যায়ে ভুগতে হয়েছে কাজের অসন্তুষ্টিতে। আর সেখান থেকেই তার ভেতর জন্ম নেয় উদ্যোক্তা হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রবল আগ্রহ। তিনি কাজ করতে চান স্বাধীনভাবে। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে নিজে কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু নিজে কিছু করার পথটা যে এত সহজ হবে না তা বেশ ভালোভাবেই জানা ছিল তার। ব্যাংকে চাকরি করার সুবাদে এবং লিটার বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি পরিচিত হয়েছেন ব্যাংকে সেবা গ্রহণ করতে আসা বিভিন্ন পেশার গ্রাহকদের সাথে। সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে যারা নিয়মিত লিটার কাছ থেকে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতেন।
লিটা খেয়াল করলেন তার পরিচিত গ্রাহকের অনেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে যুক্ত থেকে বেশ স্বচ্ছলভাবে জীবন অতিবাহিত করছেন এবং তার সমবয়সী কিছু গ্রাহক বেশ মোটা অংকের টাকা লেনদেন করছেন। এত টাকা তারা পাচ্ছে কিভাবে? লিটার মনে কৌতুহল জাগে বিষয়টা জানার। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে লিটা ভাবলেন এবং কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করে ব্যাংকের সেই চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করার উদ্দেশ্যে গ্রাফিক্স ডিজাইনে দক্ষতা অর্জন করা শুরু করলেন। ২০১৫ সালে ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট থেকে একটি প্রফেশনাল কোর্সও করলেন গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর।
এর সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটি পূরণ করবেন। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে চাকরি ছেড়ে দেন। তবে ব্যাংকের চাকরি ছাড়া এত সহজ ছিল না লিটার পক্ষে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়াতে তাকে ভাবতে হয়েছে পরিবার ও সমাজের কথা। পরিবারের কেউ রাজি ছিল না লিটার এই সিদ্ধান্তে। ব্যাংকের চাকরি পাওয়া মানেতো সোনার হরিণ পাওয়া আর সেই চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিং করবে, তা লিটার পরিবার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। তবে লিটার আত্মবিশ্বাস দেখে লিটার বাবা তার সাথে পরবর্তীতে একমত হন।
এরপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে লিটা ফ্রিল্যান্সিং শুরু করলেন। ২০১৬ সালে শূন্য পুঁজি নিয়ে ফেসবুক পেজ গিফ্ট এন্ড ডেকো চালু করলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে উপহার সামগ্রী ও ঘর সাজানোর বিভিন্ন আইটেম নিয়ে কাজ করতেন। তবে পরবর্তীতে সংযুক্ত করেছেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সেবা। থিম বার্থডে পার্টি থেকে শুরু করে বিয়ের ভেন্যু ডেকোরেশন করার সেবা পাচ্ছেন তার গ্রাহকরা। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫টিরও বেশি ইভেন্ট পরিচালনা করেছেন তিনি।
২০১৫ সালে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কোর্স করার পর থেকে তিনি ফ্রিল্যান্সিং করতেন টুকটাক। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে পুরো উদ্যমে বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটপ্লেসে কাজ শুরু করেন লিটা। খুব অল্প সময়েই তিনি হতে পেরেছেন একজন টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার। এ কাজের পাশাপাশি ২০১৮ সালে স্টাইলিং ভাইবস ফেসবুক পেজ চালু করেন যার মাধ্যমে নিজের ডিজাইনে তৈরি পোশাক, জুয়েলারি এবং হাতে তৈরি গহনা নিয়ে কাজ শুরু করেন।
পরিবারের সহযোগিতায় নিজেই সবকিছু সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। তবে কাজের চাপ বেশি থাকলে বেশ কিছু অস্থায়ী কর্মী তাকে সহযোগিতা করে। ‘প্রযুক্তিতে দক্ষ কারিগর সম্মাননা-২০১৯’ এ “সেরা মহিলা ফ্রিল্যান্সার” হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন লিটা।
উদ্যোক্তা বার্তাকে লিটা বলেছেন, ‘সকল কাজকেই যেন সুন্দরভাবে সামনের দিনগুলোতে পরিচালনা করতে পারি এবং হাজার-হাজার অসহায় মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারি, সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি’।
তিনি অনুপ্রাণিত করতে চান শত শত মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা ভাই-বোনদের যারা সমাজ কি বলবে এর ভয়ে দিনের পর দিন চাকরি করে যাচ্ছেন কাজের অসন্তুষ্টি নিয়ে।
লিটা আরো বলেন, ‘যে তরুণ ছেলে-মেয়েরা বেকার বসে আছেন তারা যেন সময় নষ্ট না করে নতুন কিছু একটা করার চেষ্টা করেন এবং সেটাতে দক্ষতা অর্জন করেন। পর্যাপ্ত ইচ্ছা, চেষ্টা, সময় ও শ্রম দিলে সফলতা আসবেই’।
তামান্না ইমাম
রাজশাহী ডেস্ক, উদ্যোক্তা বার্তা