২০টি কারণে ব্যর্থ হতে পারে আপনার ব্যবসা উদ্যোগ

0

কোন ব্যবসায় উদ্যোগ বা স্টার্টআপ তৈরির আগে আপনাকে চিন্তা করতে হবে যে প্রোডাক্ট বা সেবা নিয়ে বাজারে আসছেন তা বাজারে চলবে কিনা। অনেকেই বাজারে চাহিদার বিষয়টি বিবেচনা না করে ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর শুধু এ কারণেই ৪২ শতাংশ স্টার্টআপ বাজারে ব্যর্থ হয়।

অনেকের মাথায় দারুণ সব স্টার্টআপ আইডিয়া ঘুরপাক খায়। আর সেই আইডিয়া নিয়েই তড়িঘড়ি করে নেমে পড়েন ব্যবসায়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে তাদের সেই স্টার্টআপ বা উদ্যোগ। উদ্যোক্তা আগ্রহ হারিয়ে বসেন। নানা কারণে স্টার্টআপ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। টাকা শুধু একটা কারণ মাত্র। বিশ্বজুড়ে এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিবিআই ইনসাইডস সহ আরও কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টার্টআপ ব্যর্থতার কারণগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে। অনেকগুলো কারণ বের হয়ে এসেছে সেইসব গবেষণায়। আমাদের মতো করে আমরা অনেক কারণের মধ্যে ২০টি নীচে বর্ণনা করছি।

১। বাজারের চাহিদার দিকটি সঠিকভাবে বিবেচনায় না নেওয়া

কোন ব্যবসায় উদ্যোগ বা স্টার্টআপ তৈরির আগে চিন্তা করতে হবে যে প্রোডাক্ট বা সেবা নিয়ে তারা বাজারে আসছে তা বাজারে চলবে কিনা। তার অর্থ হচ্ছে ওই প্রোডাক্ট বা সেবার বাজার চাহিদা আছে কিনা বা তৈরি হবে কিনা। আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস আপনার কাছে একদিকে অনেক আকর্ষণীয় মনে হতে পারে কিন্তু অন্যদিকে আবার বাজারে তার চাহিদা নাও থাকতে পারে। তাই শুরুর আগে বাজারে চাহিদা কেমন তা বিবেচনা করে ব্যবসায় উদ্যোগ নিতে হবে। অনেকেই বাজারে চাহিদার বিষয়টি বিবেচনা না করে ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর শুধু এ কারণেই ৪২ শতাংশ স্টার্টআপ বাজারে ব্যর্থ হয়।

২। পর্যাপ্ত মূলধন

ব্যবসায়ের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করা ব্যবসায় সফলতার অন্যতম শর্ত। সুতরাং ব্যবসার সাফল্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্পমেয়াদি উভয় ক্ষেত্রেই শিল্প প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত মূলধনের সংস্থান করা প্রয়োজন । পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে ব্যবসায় কার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না ।

৩। সঠিক ব্যবসা মডেল না থাকা

সঠিক ব্যবসা মডেল খুব জরুরী। স্টার্টআপ ব্যর্থতার আরেকটি মূল কারণ হচ্ছে ব্যবসায় সঠিক মডেল না থাকা। শুধু ব্যবসার একটি মডেল থাকলেই হবে না, তা টেকসই এবং ঠিকভাবে চলছে কিনা সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসা ব্যর্থ হয় সঠিক মডেল না থাকার কারণে।

৪। সঠিক টিম গঠন করতে না পারা

স্টার্টআপ এ ব্যর্থতার আরেকটি কারণ হচ্ছে সঠিকভাবে টিম গঠন করতে না পারা। প্রায় ২৩ শতাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থতার কারণ সঠিক দলের সমন্বয় না হওয়া। দক্ষ ও বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ টিম না থাকলে স্টার্টআপ সফল হয় না। একটি উদ্যোগ নেয়ার সময় টিমের সদস্যদের মধ্যে যদি সমন্বয় না থাকে তবে সে স্টার্টআপ কোনভাবেই বেশি দূর এগোতে পারে না। টিম গঠন করা সহজ কাজ নয়। টিম মেম্বারদের দক্ষতার চেয়ে আন্তরিকতা ও নিবেদিতপ্রাণে কাজ করার সক্ষমতা বেশি দরকার। কাজের প্রতি মনোযোগ, একাগ্রতা এবং সমস্ত অন্তর দিয়ে কাজ করার ইচ্ছা থাকলে দক্ষতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, দক্ষতা অর্জন করা যায়। টিম মেম্বারদের একত্র হয়ে একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করাতে পারলে যেকোনো স্টার্টআপকে এগিয়ে নেওয়া সহজ হয়।

৫। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার অভাব

উদ্যোক্তাকে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা জ্ঞান ছাড়া প্রতিষ্ঠানকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ব্যবস্থাপনার মৌলিক কাজ যেমন- পরিকল্পনা, সংগঠন, প্রেষণা ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা থাকা যে কোনো উদ্যোক্তার সফলতার জন্য অপরিহার্য। উদ্যোক্তার নিজস্ব নিয়মনীতি অনুযায়ী কাজ করলে ব্যর্থ হতে পারে।

৬। নেতৃত্ব ঠিক না করা

অনেক ক্ষেত্রে ভুল নেতৃত্বের কারণে স্টার্টআপ ব্যর্থ হতে পারে। দেখা গেছে ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে উদ্যোগের ব্যর্থতার জন্য মূলত নেতৃত্ব দায়ী। উদ্যোগ সফল করার প্রয়োজনে পরিবর্তন আনার বিষয়টি ভাবতে হবে।

৭। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকা

স্টার্টআপ ব্যর্থ হওয়ার আরেকটি কারণ এর কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য না থাকা। ব্যবসা শুরুর সময় মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য বিষয়ের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে ব্যবসার ক্ষতি হয়। ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকাকে স্টার্টআপে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা।

৮। মূল্য নির্ধারণ

কোন স্টার্টআপ এ তৈরি পণ্য বা সেবার জন্যে সঠিক দাম নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। খুব বেশি বা খুব কম দাম স্টার্টআপ এ ক্ষতির কারণ হতে পারে। প্রায় ১৮ শতাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হওয়ার কারণ মূলত এটি।

৯। দূর্বল বিপণন

বলা হয়, শুধু পণ্য বা সেবা তৈরি করা যথেষ্ট নয়। তার যথাযথ বিপণন করার কৌশলও জানা থাকতে হবে। সঠিক বিপণন করার অভাবে অনেক স্টার্টআপ ব্যর্থ হতে দেখা গেছে। ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে কোন উদ্যোগের ব্যর্থতার পেছনে তার দুর্বল বিপণনকে দায়ী করা হয়। কোন ব্যবসার গ্রাহককে বোঝা ও তাদের আকর্ষণের কৌশল সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

১০। বিনিয়োগযোগ্য অর্থ ফুরিয়ে যাওয়া

অনেকের হাতে যে নগদ অর্থ থাকে তা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। যথোপযুক্ত পরিকল্পনা ছাড়াই শুরু হল কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বিনিয়োগযোগ্য ফান্ড আর হাতে নেই। আর এই বিনিয়োগযোগ্য ফান্ড হাতে না থাকা বা অর্থ ফুরিয়ে যাওয়া, পরবর্তীতে বিনিয়োগযোগ্য ফান্ড যোগাড় করতে না পারা, এ কারণে প্রায় ২৯ শতাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়। তাই ব্যবসা শুরুর আগে আপনি ভাবুন আপনার ব্যবসায়ে আয় শুরু হতে কেমন সময় লাগবে। যদি এক বছর হয় তখন আপনার ভাবতে হবে এই একবছর আপনার ব্যবসার এবং সংসারের খরচ কিভাবে চলবে। এর যদি এক বছরে আয় শুরু করতে না পারেন, যদি আরও ছয় মাস বেশি সময় লাগে তখন? বসে একটু ভাবুন, পথ পেয়ে যাবেন। তারপর শুরু করুন। যারা শুরু করে টাকার অভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা প্রয়োজনীয় চিন্তা ও পরিকল্পনা করেন নাই।

১১। সঠিক হিসাবরক্ষণ:

সুষ্ঠু ও যথাযথ হিসাবরক্ষণের উপর ব্যবসার সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। যথাযথভাবে হিসাব না করলে ব্যবসা ব্যর্থ হতে পারে।

১২। মনোযোগ ও দক্ষতার অভাব
৯ শতাংশ ক্ষেত্রে মনোযোগ ও দক্ষতার অভাবকে উদ্যোগ ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে।

১৩। সহপ্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে বিবাদ

অনেক সময় বিনিয়োগকারী বা সহপ্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে স্টার্টআপ। ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে স্টার্টআপ ব্যর্থতার জন্য সহপ্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে বিবাদই দায়ী। স্টার্টআপকে সফল করতে হলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ভাল হতে হবে, স্বচ্ছ ও সঠিক হতে হবে।

১৪। ব্যবহারবান্ধব পণ্য না থাকা

স্টার্টআপ তৈরির পণ্য বা সেবা অবশ্যই ব্যবহারবান্ধব হতে হবে। তা না হলে সে স্টার্টআপ চলবে না। ১৭ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহারবান্ধব পণ্য না হওয়ায় স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়। পণ্য তৈরির সময় ব্যবহারকারীর চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ক্রেতাই রাজা।

১৫। অসময়ের পণ্য

বাজার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য বাজারজাত করতে হবে। সঠিক পণ্য সময় বুঝে বাজারে ছাড়তে পারলে ব্যবসায় অবশ্যই লাভ আসবে। খুব তাড়াতাড়ি বা দেরিতে পণ্য বাজারে ছাড়লে তা গ্রাহকের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। স্টার্টআপ ব্যর্থতার দশম কারণ মনে হয় ভুল সময়ে বাজারে পণ্য ছাড়ার বিষয়টিকে।

১৬। অবস্থান

স্টার্টআপ বা উদ্যোগটি কোথায় নেয়া হচ্ছে, সে স্থানটিও সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পণ্য বা সেবা দেয়ার সঙ্গে স্টার্টআপের অবস্থান বড় প্রভাব ফেলে। অনেক সময় সঠিক জায়গায় উদ্যোগটির অবস্থান না হলে সেই ব্যবসা ব্যর্থ হয়। ৯ শতাংশ ক্ষেত্রে স্টার্টআপের ব্যর্থতার জন্য বাজে অবস্থান দায়ী বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

১৭। চ্যালেন্জ না নেয়া

উদ্যোক্তাদের প্রতিদিনই নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়। কিন্তু দেশের অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ঝুঁকি নিতে চান না। তাঁরা সব সময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে চান।ব্যবসা বাড়াতে চান না। তা ছাড়া অন্যের দেখাদেখি অনেকে ব্যবসায় নেমে পড়েন। ব্যবসা শুরুর আগে প্রস্তুতি নেন না। এ কারণে উদ্যোক্তারা ব্যর্থ হন।

১৮। গ্রাহকের প্রতিক্রিয়াকে মূল্যায়ন না করা

১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে গ্রাহকের প্রতিক্রিয়াকে মূল্যায়ন না করার কারণে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পণ্য বা সেবা সম্পর্কে গ্রাহক কী বলছেন সেটা বিবেচনায় নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী সেবার মান বাড়াতে হবে। গ্রাহকের প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী পরিবর্তন আনতে হবে তবেই সফলতা আসবে। তা না হলে উদ্যোগ শুরুতেই ব্যর্থ হবে।

১৯। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা

প্রতিযোগিদের হালকাভাবে নিলে তা দ্রুত আপনার ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে। প্রতিযোগিতার বাজারে অন্যদের হালকাভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রায় ১৯ শতাংশ স্টার্টআপ এ কারণে ব্যর্থ হয়।

২০। শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা

শিক্ষা গ্রহণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন ব্যবসার সফলতার পূর্বশর্ত । ব্যবসায়ে অতীত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থাকলে ব্যর্থতার চেয়ে সফলতার সম্ভাবনাই বেশি । গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায় যে ব্যবসায় পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উদ্যোক্তাগণ সবচেয়ে বেশি সফল হন ।

তাই আপনারা যারা নতুন স্টার্টআপ শুরু করবেন তাদের জন্য এই ২০টি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আপনারা যদি স্টার্টআপ শুরু করেন তাহলে আপনারা সফল হবেন বলে দৃঢ়ভাবে আশা করা যায়।

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here